মুক্তধারা
প্রবন্ধ
স্টিফেন হকিং এর চেয়ার ও চশমা
শুভঙ্কর সরকার
স্টিফেন হকিং বিজ্ঞান জগতে অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম। সেই স্টিফেন হকিং –যার শরীর কাজ না করলেও তিনি মস্তিষ্কে সবল ছিলেন। মাত্র ২১ বৎসর বয়সে হকিং স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হন। তখন থেকে তার শরীরের সমস্ত অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেল বা কাজ বন্ধ করে দিল। স্টিফেন হকিং শয্যাশায়ী হয়ে গেলে তার তিনবন্ধু তার জন্য একটা চেয়ার বানালেন।
চেয়ারটিতে ছিল পিছনে হেলান দেওয়ার স্ট্যান্ড ও হাত রাখার জায়গা, পা-রাখার জায়গা। এর সাথে লাগানো ছিল একটা কম্পিউটার, এটা পা-এর স্ট্যান্ডের নীচ থেকে লাগানো একটা স্ট্যান্ডের উপরে বসানো। এই চেয়ারের নীচের দিকে লাগানো ছিল একটা চার্জিং ব্যাটারি, এটা একবার চার্জ দিলে
২০ মাইল পর্যন্ত চলতে সক্ষম, এর গতিবেগ ঘন্টায় ৮ কিমি। চেয়ারটি তৈরী হয়েছিল সুইডেনে, কম্পিউটারটি ছিল লেনেভো কোম্পানির, চীনে তৈরি।
তার চশমাটা দেখতে একটা সাধারণ চশমার মত। কিন্তু অবাক হবার বিষয় – এই চশমার উপর নির্ভর করত তার মুখের নড়াচড়া। চশমায় লাগানো ছিল ইনফ্রা-রেড সেনসর, এর সাহায্য তার গালের নড়াচড়া ব্যাখ্যা করা যেত।
যে যন্ত্রটি তার গলায় লাগানো ছিল তা মার্কিন মুলুক থেকে বানানো। এর দাম ৫২ মিলিয়ন ডলার। এটি তৈরি করেন বিজ্ঞানী ডেনিস ক্লাটের। ‘কল টেক্সট ৩০১০’ নামের এই যন্ত্রটি হকিং-এর এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে, তিনি একই সঙ্গে তিনটি যন্ত্র কিনে ফেলেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তিনটিই ব্যবহার করতেন তিনি। ৩৩ বছর ধরে এই ‘ভয়েস সিস্টেম’ –এর সাহায্য কথা বলতেন হকিং। এটা দিয়েই দেশ বিদেশের নানা জায়গায় বক্তৃতা করতেন।
মাস কয়েক আগে এই ভয়েস সিস্টেমের দ্বিতীয় সংস্করণটি তৈরি করা হয়। গত ২৬-শে জানুয়ারি এটা তার চেয়ারে লাগানো হয়। কেম্ব্রিজের পদার্থ বিজ্ঞানী পিটার বেনি-র কথায় – ‘নতুন এই প্রযুক্তিতে তার কন্ঠস্বর অনেক স্পষ্ট, শুনতে অনেক কম যান্ত্রিক। নতুন যন্ত্রটি লাগিয়ে আত্মীয় বন্ধুদের সাথে কথা বলতে শুরু করেন। আক্ষেপের বিষয় বাইরের দুনিয়া তার নতুন কন্ঠস্বর শুনতে পেল না।
লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়াম থেকে জানানো হয়েছে – তার এই কম্পিউটার, ব্যাটারি, ভয়েস সিস্টেম লাগানো চেয়ারটি তাদের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হবে। হকিং এর স্মরণে তারা একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করবে।এই চেয়ারটি এই প্রদর্শনীর অন্যতম এক আকর্ষণ হবে।
স্নায়ুর অসুখে হুইলচেয়ারে বন্দি ছিলেন ২১ বছর বয়স থেকেই। কথাগুলোও অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। সেটাও হল, ১৯৮৫-তে।
সে বার সার্নের অনুষ্ঠানে জেনেভায় গিয়েছেন স্টিফেন হকিং। হঠাৎই নিউমোনিয়া হল। পরিস্থিতি এমন আশঙ্কাজনক হয়ে দাঁড়ায় যে শ্বাসপ্রশ্বাস
স্বাভাবিক করতে ট্রাকিওকটমি করতে হয়েছিল, মানে গলায় গর্ত করে তার ভিতর দিয়ে ‘উইন্ডপাইপ’ ঢুকিয়ে দেওয়া। তাতেই চলে গেল বাকশক্তি।
বানান লেখা কার্ড ব্যবহার করে কথা বলা শুরু করলেন হকিং। ধৈর্য ধরে এক-এক করে বর্ণ দেখাতেন। চোখের চাহনিতে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, কি বলতে চান। হকিংকে না জানিয়েই বন্ধু পদার্থবিদ মার্টিন কিং যোগাযোগ করলেন ক্যালিফোর্নিয়ার সংস্থা ‘ওয়ার্ডপ্লাস’-এর সঙ্গে।
তারা ‘ইকুয়ালাইজার’ নামে একটি প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছিল, সেখানে হাতে রাখা যন্ত্রে ক্লিক করে কম্পিউটারের মাধ্যমে শব্দ বা কথা বোঝানো যায়।
হকিংয়ের জন্য ‘ইকুয়ালাইজার’-এর সঙ্গে যুক্ত করা হল ‘স্পিচপ্লাস’ নামে একটি সংস্থার তৈরি যন্ত্র ‘স্পিচ সিন্থেসাইজার’। হুইলচেয়ারের একটি হাতলে লাগিয়ে দেওয়া হল সেটি। হাতের যন্ত্রে মগজের শব্দ কম্পিউটার-বন্দি হল। সিন্থেসাইজার মারফত ভেসে উঠল সেই কথা। এক মিনিটে ১৫টি পর্যন্ত যান্ত্রিক শব্দ প্রকাশ করতে পারতেন হকিং। এতে তাঁর প্রথম বলা কথাই ছিল— ‘‘এক জন সহকারী দরকার, ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ শেষ করতে হবে।’’
১৯৯৭ সালে হকিংয়ের সঙ্গে দেখা হল ‘ইনটেল’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরের। তিনি প্রস্তাব দেন, ‘‘মাইক্রোপ্রসেসর সমেত আমাদের আসল কম্পিউটার ব্যবহার করুন।’’ এর পর থেকে হকিংকে যাবতীয় প্রযুক্তিগত সাহায্য করে গিয়েছে ইনটেল। প্রতি দু’বছর অন্তর তাঁর কম্পিউটার বদলে দিত তারা। ২০০৮ সালে ফের ধাক্কা। হাতের সাড়ও গেল। বুড়ো আঙুল চালানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন হকিং। মিনিটে একটা শব্দের বেশি বলা সম্ভব হচ্ছিল না। বন্ধ হয়ে যায় টাইপ করা। এবং ‘কথা বলা’ও।
তখন গর্ডন মুরকে চিঠি লেখেন হকিং - ‘‘আজকাল আমার স্পিচ ইনপুটের গতি খুব ধীর হয়ে গিয়েছে। আপনারা কী কোনও ভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারেন?’’
সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া হকিংয়ের সহকারীটি তখন ‘চিক স্পিচ’ নামে যন্ত্র নিয়ে কাজ করছেন। ইনফ্রারেড রশ্মির সাহায্যে কাজ করে সেটা। হকিংয়ের চশমার সঙ্গে লাগানো হল যন্ত্রটা। অন্য অংশ সফ্টঅয়্যার-সমেত লাগানো হল গালে।
হকিংয়ের মাথাও তখন এক দিকে কিছুটা পড়ে গিয়েছে। মুখ নড়ে না। কথা বলার চেষ্টা করলে, শুধু গালের একটিমাত্র পেশি কাজ করে। ওই পেশির কম্পনই পড়ে ফেলত সফ্টঅয়্যার।
মুরের নির্দেশে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজে নামেন ইন্টেলের ইঞ্জিনিয়াররা। হকিংয়ের গালের একটা পেশি ও চোখের কুঞ্চন, রেটিনার স্ক্যান এবং মস্তিষ্কের তরঙ্গ— এ-টুকু সম্বল করেই এক অসম লড়াই শুরু হয়। অধ্যাপকের শরীরে মারণ এএলএসের দ্রুত বংশবিস্তারের সঙ্গে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির লড়াই। গত কয়েক দশক ধরে কিন্তু রোগকে জিততে দেননি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়াররা। অসংখ্য বক্তৃতা দিয়েছেন অধ্যাপক, সারা পৃথিবী শুনেছে তাঁর যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর।
কিন্তু ২০১১ থেকে ক্ষীণ হতে থাকে সেই শক্তিও। মিনিটে মাত্র দু’টি শব্দ বলতে পারতেন। মুরকে লিখলেন, ‘‘কথা বলার গতি খুব কমে গিয়েছে। আপনার সংস্থা কি সাহায্য করতে পারে?’’ মুরের নির্দেশে হকিংয়ের ৭০তম জন্মদিনে ইনটেলের গোটা ল্যাব চলে গিয়েছিল কেমব্রিজে। কিন্তু লাভ হয়নি। হকিং নিজেই বলতেন, ‘‘মানুষের মস্তিষ্ক হল আসল কম্পিউটার। যখন ওর অংশগুলো খারাপ হয়ে যাবে, কম্পিউটার কাজ করা থামিয়ে দেবে। ভাঙা কম্পিউটার কি পুনর্জীবন পায়? না স্বর্গে যায়?’’
Comments :0