গল্প
মুক্তধারা
অপারেশন
দেবাশিস ভট্টাচার্য
থমথমে অন্ধকার। ডানপিটে এক ঝলক বাতাস ছুটে এলো নামহীন গলিটার দিক থেকে। শুকনো সাপের মতো বাঁকা গলি। ল্যাম্পপোস্টের অন্ধ টুনির ওপর জড়াজড়ি বৈদ্যুতিক তার। একটু আগে এখান দিয়ে দৌড়ে গেছে ঘাতক চটি। জিতে যাওয়ার হিড়িকে ফেলে গেল দু - দুটো মানুষ। মুঠোগুলো তখনো শক্ত পড়ে যাওয়া মানুষগুলোর। একতারার তারের মতো কাঁপছিল ওদের দেহ।
এখন ওদের শরীরে বুলেটের ওম নেই। গুন্ডা পালিত বুলেট। ওদের শরীরগুলোয় ঢাকা দিয়ে দিয়েছিল কেউ। সেই চাপা দেওয়া কাপড়টা দেখে মনে হচ্ছিল বাতাসের রং সাদা।
দেখা গেল ওদের একজন এবার উঠে বসলো ধীরে ধীরে। দেখলো তার পাশে পড়ে আছে আরো একটা সত্যিকারের লাশ। ধাতু দিয়ে খোঁড়া বুকের মাংস। গ্রিসের যোদ্ধার মত বীর দেখাচ্ছিল মানুষটাকে। প্রথম লোকটা বলল, ‘শুনছো, এবার উঠে পড়ো ভাই।’
দ্বিতীয় লোকটা এবার তাকালো চোখ মেলে। দেখল সামনের মানুষটার বুকে পোকায় কাটা কাগজের মত অনেকগুলো ফুটো। বলল, ‘তোমারও গুলি?’
লোকটা যেন অনেক কষ্ট করে শুনলো কথাগুলো। যেমন মৃতদেহ শোনে দাহর মন্ত্র। বলল, ‘হ্যাঁ, এলোপাথাড়ি’।
- আমার আবার তার ওপর লাঠি, রড ।
-তাই তো দেখছি! থেঁতলে গেছো একেবারে! উঠে বসতে পারবে?
- পারবো। তবে আমাকে একটু সাহায্য করো।
প্রথমজন হাত বাড়িয়ে সাহায্য করলো, উঠে বসলো দ্বিতীয়জন। বললো, ‘আচ্ছা এখন কি করা যায় বলোতো?’
-কি করা যায় মানে?
-মানে আমাদের তো বিনা দোষে মারলো। এর বিচার হবে না?
- কি করে হবে! মরা মানুষের বিচার তো জ্যান্ত লোকেরা করে। বলতে চাইছি পুলিশেরা।
- ধুস, তাহলে কোন আশাই নেই! দেখলে না আমাদের আগে ৪৮ জনের কোন বিচারই হলো না।
- আশ্চর্য!
- হ্যাঁ ভাই জোর করে জেতার জন্য যত লাশ লাগে লাগুক। তাছাড়া...
- তাছাড়া!
- তাছাড়া এর জন্য ওপরের পারমিশন আছে।
- ওপরের পারমিশন!
-হ্যাঁ গো, দেখলে না, যাদের রক্ষা করতে আসার কথা ছিল তাদের নিয়ে কত গড়িমসি! এসব হল ওই গিভ এন্ড টেক পলিসি!
- বাবা! তুমি ইংরিজিও জানো দেখছি!
- না মানে ওই একটু আধটু।
- তাহলে একটা দরখাস্ত লেখো দেখি। বেশ কড়া করে।
- দরখাস্ত! কাকে!
-কাকে লেখা যায় বলতো?
- আরে তুমিই তো দরখাস্ত লেখার কথা বললে!
- ও হ্যাঁ। এক কাজ করো। ডাইরেক্ট মুখ্যমন্ত্রীকে লিখে ফেল।
- পাগল! তুমি হলে গিয়ে ৪৯নম্বর। আর আমি পঞ্চাশ। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মাত্র ১৯ জনের হিসেব আছে।
- তাহলে!
-মুখ্যমন্ত্রীর হাতে দরখাস্ত গেলে কি হবে জানো?
-কি!
- তখন আর তুমি জীবিতও নও, মৃতও নও। জীবনের কোনো পাড়েই আর তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না!
- বলো কি! একটা মানুষ পৃথিবীতে জন্মালো, বড় হল, প্রকাশ্য রাস্তায় বন্দুকের গুলিতে লুটিয়ে পড়লো, সেই মানুষটা উবে যাবে পৃথিবী থেকে!
-হ্যাঁ ভাই এখন এইরকমই দিনকাল। যাগগে ছাড়ো। তোমার তো কবর?
- হ্যাঁ আমার ভাই দাহ। আচ্ছা আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
- বুদ্ধি!
- হ্যাঁ সময় কম। আর কিছুক্ষণের মধ্যে শেষকৃত্য হয়ে যাবে আমাদের।
- তো!
- কটা জিনিস জোগাড় করতে পারবে?
- জিনিস!
- হ্যাঁ গো।
- কি জিনিস বলতো!
- ওই একটা সিংহাসন, একটা মুকুট, আর তিনটে সিংহের মাথা।
- তিনটে সিংহের মাথা মানে অশোক স্তম্ভ!
- হ্যাঁ। ঠিক ধরেছো। অশোকস্তম্ভ।
- কিন্তু এগুলো জোগাড় করে কি হবে!
- কাজ আছে। জোগাড় করতে পারবে কিনা বলো?
- এ আর এমন কি! এগুলো জোগাড় করা খুবই সহজ।
- তাহলে চলো। সময় বেশি নেই।
ওরা একটা বহুতল বাড়ি থেকে তুলে আনলো একটা কাঠের নড়বড়ে সিংহাসন। মুকুটটা নিয়ে এলো সুদূর নবাবের আমল থেকে। আর খোদ দিল্লি থেকে নিয়ে এলো তিনটে সিংহের মাথা। দ্বিতীয় মানুষটা বললো, এবার!
- প্রথম মানুষটা একটা কাঁচের পাত্রে প্রথমে রাখলো তিনটে সিংহের মাথা। তারপর রাখলো বাকি দুটো। বললো, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছ, তোমার কষ্ট হচ্ছে না!
- কষ্ট হচ্ছে না আবার! মেয়েটার জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে। মুখটা মনে করলেই হু হু করছে বুকের ভেতরটা।
- জানো, আমারও হচ্ছে মায়ের জন্য। অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। মাটির গড়া মূর্তি চেপ্টে গেলে যেমন দেখায়। যাকগে ছাড়ো। তোমার তো দেখছি বেশ কান্না পাচ্ছে?
- পাচ্ছে তো!
- তাহলে এসো এই পাত্রের উপর মুখ রেখে আমরা কাঁদি।
কাঁদছিল ওরা। অগ্নিরং অশ্রু ঝরছিল ওদের চোখ থেকে। পাত্রের ভিতরে রাখা জিনিসগুলো ঢেকে যাচ্ছিল সেই তরলে। দ্বিতীয়জন হাত ঢুকিয়ে ওর ভেতরের সিংহাসনটা তুলতে গেল। পারলো না। প্রথমজন জিজ্ঞাসা করলো, কি হলো!
- সিংহাসনটা তোলা যাচ্ছে না। এঁটে গেছে।
- আর সিংহগুলো?
-সিংহগুলো সিংহাসনের নিচে চাপা পড়ে আছে। উঠছে না। ওটাও এঁটে গেছে ভাই।
প্রথমজন এবার নিজে মুকুটটা ধরে পরীক্ষা করে দেখলো, ওটাও বেশ শক্ত হয়ে জড়িয়ে গেছে ওগুলোর সঙ্গে। দ্বিতীয় জন বললো, এটা কি করলে?
- আমি কিছু করিনি। এটাই এখন আমার দেশ। ভারতবর্ষ!
- কিন্তু এটা নিয়ে কি করবো আমরা!
- এটা একটা উঁচু জায়গায় রেখে আসি চলো। বেশ উঁচু জায়গায়। বুদ্ধিমান মানুষ কাল সকালে যা বোঝার বুঝে নেবে।
Comments :0