STORY — SOURAV DUTTA / MUKTADHARA

গল্প — কমেডি অফ এর রস্ / মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

STORY  SOURAV DUTTA  MUKTADHARA

গল্পমুক্তধারা

কমেডি অফ এর রস্

সৌ র ভ  দ ত্ত

স্যার, আপনি গোলকিপিং করেছেন কখনো?
–আকিকুলের প্রশ্নটা আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল শৈশবের রহস্যময় মাঠে।
বললাম– ওই ইন্টারক্লাস লিগে দু-একবার।সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আজ 'খেলা হবে দিবসে'র ম্যাচ চলছে কাজিরচক তেঁতুলতলার মাঠে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে চিৎকার আর তুমুল শব্দ ব্যঞ্জনার মধ্যে দুই স্কুলের খেলা চলছে।
অনেকটা ঠিক ধন্যি মেয়ে সিনেমার– হাড়ভাঙা Vs সর্বমঙ্গলা স্পোর্টিং স্টাইলের সিকোয়েন্স।
এর মাঝেই আমাদের টিমের এক স্টপারকে জোল ধাক্কা মারল অপনেণ্টের একজন খেলোয়াড়। সঙ্গে সঙ্গে সাইড লাইনের পাশ থেকে সমস্বরে চিৎকার উঠল–খেলা হবে…
লাইসম্যান হুইসেল বাজাল। ঝামেলা থামাতে আমাদের হেডস্যার তড়িঘড়ি ছাতা হাতে ছুটে আসছেন। খানিকক্ষণ বাকবিতণ্ডার পর আবার ম্যাচ শুরু। সেকেণ্ড হাফে খেলা শুরু হতেই সেন্টার বক্স থেকে হু-হু বল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে গোল করে গেল–আনন্দ নিকেতন স্কুলের ফুটবলার সাব্বির সেখ। গোলকিপার বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে সাইড ব্যাকের মুখে সজোরে এক থাবড়া মারল।তার নাক ফেটে রক্ত বেরোল।তেঁতুলতলার গোটা মাঠ জুড়ে রব উঠল গো-ও-ল। আমরা হেরে গেলাম ১-০ গোলে। ঝন্টু,পলাশ,রুদ্র,আরিফরা সব মুখ গোমড়া করে মাঠের কোণে বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে।পুরস্কার বিতরণ পর্বের পর মাঠে বীভৎস ডি.জে বক্স আর কুৎসিত উল্লাস প্রদর্শনে মেতেছে জয়ী দলের ফুটবলাররা। পুরস্কার বিতরণ শেষে মাঠে থেকে ফেরার সময় কানে কানে কেউ ইনসাল্ট করে বলে গেল –খেলা হবে। এর ঠিক দু-চারদিন বাদের ঘটনা– ক্লাস নাইন-টেনের ছেলেরা ধরল স্যার ;আজকে টিভি দেখবেন তো। সরাসরি লাইভ দেখাবে?আমি বললাম কি দেখবো ?ওরা বলল ঐ যে  আজ সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে  'বিক্রম' চাঁদের মাটিতে পা দেবে। মনে পড়ল–এই রে ভুলেই গেছি।ঠিক তো! আজ চন্দ্রযান-৩ চাঁদের মাটিতে ল্যাণ্ডিং করবে।বেলায় হেডস্যার বলছিলেন বটে–বাড়ি গিয়ে দেখতে হবে চন্দ্রাভিযানের পুরো ব্যাপারটা। অনেকে আগেভাগেই স্কুল থেকে বেরিয়ে গেছে 'মেড ইন ইণ্ডিয়া, মেড ফর দ্য মুন' দেখার জন্য। বিকেল চারটেয় ক্লাস শেষ করে নীলকুঠির বাঁধ টপকে যখন বাড়ি ফিরছি কৌশিকী নদীর কর্দমাক্ত জল থেকে বিশ্রীপূতি গন্ধ নাকে এসে লাগছে। তার মাঝে অভিচিন্তনে ভাসছে আমাদের স্কুলের ছেলেপুলেদের কথাগুলো।কত কত কোটি টাকা ব্যায়ে না এই প্রোজেক্ট বানানো হয়েছে। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে– হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি এল। ব্যাগ থেকে কোনক্রমে শিকভাঙা ছাতাটা বের করে বর্ষণ আটকাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। এতটা পথ আসতে আসতে জামা-প্যান্ট সব ভিজে ডাব।পিঠের ব্যাগে ক্লাস সেভেনের বাংলা খাতা সব পয়মাল হয়ে যায় বুঝি!তার উপর বার দু'য়েক সাইকেলের চেন পড়ল। কোনরকমে চেন তুলে সজোরে প্যাডেল করে এসে হাজির হলাম  হাফেজপুর সাধারণ পাঠাগারে। এই গ্রামীণ পাঠাগারে বসে পুথি সাহিত্যের বই পড়ছেন সত্তোরোর্ধ সাদিক মাস্টার।

 

ভেজা ব্যাগটা বেঞ্চে নামিয়ে রেখে বললাম–স্যার, কেমন আছেন? বই থেকে খানিকটা মুখ সরিয়ে জলদগম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলেন– ভালো থাকার চেষ্টা করছি মাত্র–কিন্তু থাকব বললেই কি থাকা যায়! দেখছো না সারাদেশ আর রাজ্যের কি পরিস্থিতি–মনিপুর জ্বলছে, মালদা জ্বলছে।হঠাৎ হঠাৎ ট্রেন দুর্ঘটনায় কতজনের প্রাণ যাচ্ছে। কত পরিযায়ী শ্রমিক না খেয়ে মরছে।আম্বানি আদানিরা দেশের কত হাজার কোটি টাকা টপেটস্থ করে বসে আছে। আর এদিকে গুজরাট দাঙ্গার নায়ক দ্যূতসভায় দিব্যি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সেজে বসে আছেন। টিভিতে 'মন কি বাত' ভাষণ আওড়াচ্ছেন। বৃদ্ধ সাদিক মাস্টারের কথাগুলো বেশ নাড়া দিল।বেশ অদ্ভুত কথা বলেন সাদিকবাবু। এলাকায় দীর্ঘদিন নাট্যচর্চা করেছেন।ব্রেখট,চেকভের প্রমুখ বিদেশি নাট্যকারের বেশ কতগুলি নাটক 'সুচেতনা গোষ্ঠী' -র পক্ষে সুন্দর  মঞ্চায়ন করেছেন। শাহ গরীবুল্লাহের পুঁথিসাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রচুর বই লিখেছেন। বিশ্বায়নের বাজারে পাড়াগাঁয়ে  এরকম মানুষ মেলা ভার।প্রবল বৃষ্টিতে আজ পাঠাগারে সেরকম কেউ আসেনি। সন্ধে ছটা বাজতেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে  লাইব্রেরিয়ান বলল– আপনি তো আপাদমস্তক ভিজে গেছেন মশাই। তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে জামাকাপড় বদলে স্নান করে নিন। না হলে বিপদে পড়বেন।জ্বর-সর্দি হতে পারে। আমিও ছটা দশের ট্রেনটা ধরব। বাড়ি গিয়ে চন্দ্রযান -৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতোরণের এর পুরো রিভিউটা দেখতে হবে। এদিকে বই পড়া বন্ধ করে বৃদ্ধ সাদিক মাস্টার বলল–আমিও তাহলে উঠি। বর্ষায় অনেকটা পথ যেতে হবে…।

Comments :0

Login to leave a comment