STORY — SOURAV DUTTA / NATUNPATA - 15 OCTOBER

গল্প / নতুনপাতা / দাদুর বিষপাথর সৌরভ দত্ত - ১৫ অক্টোবর

ছোটদের বিভাগ

STORY   SOURAV DUTTA  NATUNPATA - 15 OCTOBER

গল্প / নতুনপাতা

দাদুর বিষপাথর

সৌ র ভ  দ ত্ত

(গত রবিবারের পর)

তারপর সেখানে গিয়ে কি দেখি জানিস ছোট্ট একটা ঘরে বৃদ্ধ অশতিপর এক সন্ন্যাসী মৃত্যু শয্যায়।পাশে কুঁজোয় জল রাখা সেই জলটুকু নেওয়ার মতো উত্থান শক্তি নেই।এতটাই অসুস্থ তিনি।তাকে আমি সাময়িক সেবা শুশ্রূষা দিয়ে সামান্য সুস্থ করে তুলি।তিনি গঙ্গাসাগরের বিভিন্ন মিথ-ইতিহাস আমাকে বলেন।এবং আমার এই সেবাপরায়ণতা দেখে একটা চমকপ্রদ কৌটো আমাকে উপহার দেন।কৌটো খুলে আমি অবাক হই।কালো চকচকে পোকাজাতীয় জিনিস।ওই পূণ্যাত্মা ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন– এটার নাম 'বিষপাথর'।কাউকে সাপে কাটলে সেই ক্ষতস্থান এটা বসিয়ে রাখা হয়।বিষটা শোষণ করে নিলে রুগী সুস্থ হয়ে যায়।তিনিই আমাকে বিষপাথরটা উপহার দেন।ওনার ঘরেই আমি মাসখানেক ছিলাম।দাঁড়া তোদের জিনিসটা দেখাচ্ছি।"

দাদু পাশে রাখা ঝোলা ব্যাগ থেকে সেই কারুকৃতিময় মহার্ঘ্য কৌটোটা বের করে। মাসির হাতে দেয়।তখন গোটা চন্ডীমণ্ডপে লোক থইথই করছে। পাশের পাড়ার ছেলেপুলেরাও এসে জুটেছে।কৌটো খুললে দেখা যায় এক অত্যাশ্চর্য কালোরঙের পোকা।লালসিঁদুর গুঁড়োর ভিতরে ওই পোকাটা রয়েছে।

এরপর দেখেছি গ্রামের কাউকে সাপে কাটলেই রাতবিরেতে পাড়ার লোকেরা চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ে আসত।রোগীর ক্ষতস্থানে দাদু বসিয়ে দিতেন সেই বিষপাথর। সারারাত রোগীর সামনে বসে গোটা বিষয়টা নিরীক্ষণ করতেন দাদু।রোগীর দেহ বিষমুক্ত হলে বিষপাথর এমনি এমনি খসে পড়ত।তারপর কাঁচা দুধে সেটি ডুবিয়ে দাদু দেখাত কোন সাপের কতটা বিষ।বিষের মাত্রা অনুযায়ী দুধের বর্ণ –গোলাপী,হলুদ,নীল,সবুজ প্রভৃতি হত।একবার সন্ধ্যাবেলা ভাঁড়ার ঘরে চাল আনতে গিয়ে  মামনিকে খরিস সাপ কামড়ালো।মামনির মেজাজ ছিল খুব চড়া।মামনিও সাপকে লাথি মেরে বলল –"ওরে ওলা-উঠো আমায় কামড়ালি"।মামনির লাথি মারাতে আবার দংশন করল সাপটা।সেবারও দাদু মামনির পায়ে বিষপাথর লাগিয়ে দিলেন। বাড়ির সবাই উৎকণ্ঠায় সারারাত জাগল।কিন্তু ভোরের দিকে খসে গেল বিষপাথর। দুবার কামড়ালেও মামনি এক্কেবারে সুস্থ।বিভিন্ন সময় দেখেছি খবর পেয়ে গ্রামের বাইরের মানুষজনরাও সাপে কাটা রোগী নিয়ে আসত বাড়ির সদর উঠোনে।

এরপর হঠাৎ দাদু, দিদা মারা গেল।অনেকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেল অন্যত্র।ভেঙে গেল আমাদের একান্নবর্তী সংসার।আমরা পাশের ডাঙায় বাড়ি করে রয়ে গেলাম।কালের প্রবাহে আস্তে আস্তে ভেঙে পড়তে লাগল বসুবাড়ির ভদ্রাসন।বছর দশ-পনেরোর মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল গোটা বাড়িটা।একদিন ও বাড়িতে খেলতে গিয়ে দাদুর ভাঙা ঘর থেকে পেলাম একটা সুন্দর কৌটো।যদিও তাতে কিছুটা জং ধরেছে।মাকে এনে কৌটোটা দিলাম।মা কৌটো খুলে দেখল এটা সেই দাদু'র বিষপাথর।চিকচিক করে উঠল মায়ের চোখ।

সেই কৌটোটা মা যত্ন করে তুলে রেখেছিল আমাদের লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে।প্রতিবার বাড়িতে লক্ষ্মী পুজোর দিন সকালে কৌটোয় সিঁদুর ভরে আবার মুখ বন্ধ করে রেখে দিত।পোকাটা বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করত না।মা বলত–"এই পাহাড়ি পোকা শুধু সিঁদুর খেয়েই বছরের পর বছর বাঁচে।"

দীর্ঘদিন রোগভোগের পর গতবছর এক শীতের সকালে মাও অমৃতলোকে হারিয়ে গেছেন।সেদিন লক্ষ্মীপুজোর দিন হঠাৎ আমার মেয়ে লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে খুলে বের করেছিল ওই বিষপাথরের কৌটোটা।কৌটোর মুখটা খুলেই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে…ফিরে যাই স্মৃতির
বায়োস্কোপে…চণ্ডীমণ্ডপে বসে সাপে কাটা রোগীর পায়ে সযত্নে বিষপাথর লাগাচ্ছেন দাদু…বিষপাথরের কৌটো'টায়… আ-আ -আ-মার দাদু, দিদা, মায়ের স্পর্শ লেগে আছে।উত্তরাধিকারের চিহ্ন।মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে–"সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার।"

Comments :0

Login to leave a comment