CPI-M STATE CONFERENCE

মানব জমিনে ফলাতে হবে সোনা, জবাবী ভাষণে মহম্মদ সেলিম

রাজ্য

যা ছিল কুমারহট্ট গ্রাম তা আজ হালিশহর। গাঙ্গেয় অববাহিকার সেই গ্রামে অন্তত তিনশো বছর আগে জন্ম নেওয়া কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন মঙ্গলবার উচ্চারিত হলেন হুগলীর ডানকুনিতে, সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চে। শিমূল, পলাশের আগুন ছড়িয়ে থাকা এই ফাল্গুনে তাঁকে উদ্ধৃত করলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
এদিন খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনের উপর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জবাবী ভাষণ দিচ্ছিলেন মহম্মদ সেলিম। সম্মেলন স্বভাবতই তখন শেষ পর্যায়ে। পার্টির রাজ্য সম্পাদক বললেন, কী আছে সেই লাইনগুলিতে? এমন মানব জমিন রইলো পতিত/ আবাদ করলে ফলত কী? ফলত সোনা। সোনা ফলত। কবি লিখেছেন। গান হয়েছে। মানব জমিন অনাবাদী পড়ে থাকে না। সেই সব মানব জমিন জুড়ে একদিন আমরাই ছিলাম। আমাদের ফিরতে হবে সেখানে। অনেকে সেই জমি নিতে চাইছে। ‘কেন নিচ্ছে’, ‘নিয়ে নিচ্ছে’ বলে চিৎকার করলে হবে না। আমাদের আজ সেই পতিত জমিতে আবাদ করতে হবে, সোনা ফলাতে হবে। আমরা অতীতমুখী নই। আমরা অতীতের খাঁচায় বন্দি নই। আমরা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা ভবিষ্যৎমুখী। বিশ্বের জন্য, দেশের জন্য, পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের জন্য আমাদের লড়াই। 
খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ হয়েছিল গত শনিবার, সম্মেলন শুরুর দিন। গত প্রায় তিনদিনে ১০ জন মহিলা সহ ৭৭ জন আলোচনা করেছেন প্রতিবেদনের উপর। তাঁদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন জেলাগুলির প্রতিনিধি। ৬৬০ মিনিট আলোচনা হয়েছে সম্মেলনে খসড়া প্রতিবেদনের উপর। সম্মেলনে ৩১টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো আগামী কর্মসূচি সম্পর্কিত। যা মঙ্গলবার গৃহীত হয়েছে। 
জবাবী ভাষণে মহম্মদ সেলিম বলেন, পরিসর, চেনা বৃত্ত, গণ্ডি, কমফর্ট জোন ছেড়ে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। তৃণমূল নয়, বিজেপি নয়, এমন যে কোনও মানুষের কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে। এমন অনেকে আছেন যাঁদের আমাদের সঙ্গে থাকার কথা। দূরে আছেন। নানা কারণে আছেন। তাঁদের আর আমাদের মাঝে কোনও লক্ষ্মণরেখা নেই। থাকতে পারে না। তাঁদের কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে। যাঁরা লড়তে চাইছেন, তাঁদের সবার কাছে আমাদের যেতে হবে। বলতে হবে আসুন, একসঙ্গে লড়ি। 
পার্টির রাজ্য সম্পাদক আরও বলেন, নদীকে ঘিরে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করা হচ্ছে। গঙ্গার পাড়ে কুম্ভ মেলা হয়েছে। তাকে ঘিরে গণ-হিস্টিরিয়া তৈরির চেষ্টা হয়েছে। নদীর কথাই যখন উঠছে তখন দু’জনের কথা বলি। একজন ওস্তাদ বিসমিল্লা খান। তাঁকে আমেরিকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বলেছিল, সব দেবো। আপনি আসুন। বিসমিল্লা খান বলেছিলেন, সব তো দেবে। আমার গঙ্গা এনে দিতে পারবে আমেরিকায়? এ হচ্ছে প্রকৃতি প্রেম। আর একজনের কথা বলি। তিনি হচ্ছেন রাহী মাসরুম রেজা। তিনি মহাভারত সিরিয়ালের ডায়লগ লিখেছিলেন। নিজেকে গঙ্গা পুত্র বলতেন। তাঁর একটি কবিতা ছিল যে, মৃত্যুর পর আমার দেহ নদীর তীরে কবর যেন দেওয়া হয়। কবর দেওয়ার পর যেন বলা হয় গঙ্গার পুত্র ছিল। এখানে দিয়ে গেলাম। কারণ সব নদী গিয়ে মেলে মহাসাগরে। সব ধারা গিয়ে মেলে এক জায়গায়। সাম্প্রদায়িক শক্তি, কর্পোরেট-হিন্দুত্ব চক্র যখন সব ভাঙছে, খণ্ড খণ্ড করছে, তখন আমাদের মতাদর্শ, আন্তর্জাতিকতাবোধ, পার্টি কর্মসূচির বোঝাপড়ার ভিত্তিতে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের মগজে ওরা ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। আমাদের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে, লড়াই করতে হবে। আমাদের নাছোড়বান্দা হতে হবে। সংগ্রামে আপসহীন হতে হবে। আপসে কোনও লড়াই হয় না। আর সেই নাছোড়, আসপহীন সংগ্রামের উপযোগী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। সেলিম বলেন, মানুষ অসহায়, ভরসাস্থল খুঁজছে। আমাদের ভরসা হয়ে উঠতে হবে সেই মানুষের। বিভিন্ন লড়াইয়ের সঙ্গে আরও বিষয়কে যুক্ত করতে হবে। জমির লড়াই করছি। তার সঙ্গে পরিবেশের প্রশ্নকে যুক্ত করতে হবে। এমনভাবেই সমাজে মানুষের সমস্যাগুলির প্রতিটির ক্ষেত্রে আমাদের ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করতে হবে। 
পার্টির রাজ্য সম্পাদক বলেন, মানব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী আছে প্রত্যেক যুগে নতুন নতুন ধরনের সঙ্কট, বৈষম্য হাজির হয়। নতুন প্রজন্মের উন্নত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃৎকৌশল আবিষ্কার করে সেই সঙ্কটের মোকাবিলা করে উত্তরণ ঘটানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন হয় পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, শতাব্দী সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, উন্নততর দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং তার প্রয়োগ। আমাদের সৃজনশীল হতে হবে। উদ্ভাবনী শক্তিকে ব্যবহার করে প্রযুক্তি নির্ভর, জ্ঞান নির্ভর অনুশীলন করতে হবে আমাদের। তা করতে হবে সৃজনশীল হয়ে। তার মাধ্যমে এগিয়ে চলার রাস্তা করে নিতে হবে। 
মহম্মদ সেলিম বলেন, ভবিষ্যৎমুখী স্বপ্ন দেখাতে হবে। আমাদের বলতে হবে সমাজতন্ত্রের কথা। বলতে হবে সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ। সবচেয়ে কঠিন, কঠোর সময়ে কমিউনিস্টদের সত্যকে উচ্চারণ করতে হয়। বারবার করতে হয়। দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে করতে হয়। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন সময় লাগবে বুঝতে। কিন্তু আমাদের বলতেই হবে। কারণ আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে সবারই একদিন সেই বিশ্বাস হবে। আমরা ধারার বিপরীতে নেমেছি। স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে নেমেছি। আমরাও জানতাম কিনারায় বসলে অনেক আরামদায়ক পরিস্থিতি থাকতো। আমরা সেই কমফর্ট জোন থেকে বেরিয়ে ধারার বিপরীতে লড়তে নেমেছি। সেই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে যে, আমরা এক উজ্বল ভবিষ্যতের জন্য লড়তে নেমেছি। বিশ্বের জন্য, দেশের জন্য, রাজ্যের জন্য সেই লড়াই। অতীতমুখী নয়, ভবিষ্যৎমুখী। ভবিষ্যৎ বাংলার ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য আমাদের পার্টিকে সুদৃঢ় করতে হবে। 

Comments :0

Login to leave a comment