রাষ্ট্র নরেন্দ্র মোদী বা মমতা ব্যানার্জির নয়। তাঁদের সরকারের কোনও হকই নেই সাধারণ মানুষের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার। সংবিধান দেশের জনগণকে নাগরিকত্বের অধিকার দিয়েছে। আক্রান্ত মানুষকে আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। শুক্রবার নাগরিকত্ব নিয়ে এক কনভেনশনে প্রাক্তন সাংসদ, গণআন্দোলনের নেতা মহম্মদ সেলিম একথার উল্লেখ করে বলেন, দেশের মূল যন্ত্রণা ও সমস্যা জিইয়ে রেখে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে সরকার, নতুন নাগরিকত্ব আইনের নামে মারতে চাইছে গরিবকে। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য, ধর্মের নামে, ভাষার নামে মানুষকে ভাগ করা যাবে না। দেশ ছেড়ে, রাজ্য ছেড়ে কেউ কোথাও যাবে না। কনভেনশনে প্রাক্তন সাংসদ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা রামচন্দ্র ডোম বলেন, বাংলার মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধ ক্রমশ আরও জোরদার হবে। নির্বাচন আসছে, এর যোগ্য জবাব দিতে হবে।
এদিন পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চ, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চ, ‘আওয়াজ’, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘ, ইউসিআরসি এবং পশ্চিমবঙ্গ বস্তি উন্নয়ন সমিতি একযোগে ‘নাগরিকত্ব’ বিষয়ে এই কনভেনশনের ডাক দেয়। মৌলালী যুবকেন্দ্রে আয়োজিত এই কনভেনশনে মহম্মদ সেলিম, রামচন্দ্র ডোম ছাড়াও বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন সাংসদ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা সুজন চক্রবর্তী।
শুরুতে দাবি প্রস্তাব উত্থাপন করে নাগরিকত্বের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চের পক্ষে অলকেশ দাস। বিভিন্ন সংগঠনগুলির তরফে বক্তব্য রেখেছেন অমিয় পাত্র, পুলিনবিহারী বাস্কে, সুখরঞ্জন দে, মধু দত্ত, নুরুল গাজী এবং শের আলি। কনভেনশন পরিচালনা করেন তুষার ঘোষ, বাসুদেব বর্মণ, জীবনরঞ্জন ভট্টাচার্য, আলেয়া ফিরদৌসী, সাইদুল হককে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী। উপস্থিত ছিলেন রেখা গোস্বামী, সুমিত দে, দেবেশ দাস প্রমুখ।
মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ যাতে কোনও প্রশ্নে একজোট না হতে পারেন তার জন্য বিশেষ সচেষ্ট থাকে সরকার। তাই কখনো ধর্ম, জাতপাত, সংখ্যালঘু প্রশ্ন তুলে, পোশাক কিংবা ভাষার নামে মানুষের মধ্যে বিভাজন আনতে চায়। সিএএ, এনপিআর, এনআরসি নিয়ে কথা বলে, নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে চায়। আর ভোট এলে তখন ভয় দেখাতে নাগরিকত্বের লোভ দেখায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে সরকার নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য বসে নেই, নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে উৎসাহী তারা, সেজন্যেই আইন করছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘এদের লক্ষ্য সেই মানুষগুলিই, যাঁরা প্রান্তিক গরিব মানুষ, যাঁদের কোন কাগজপত্র নেই, জোগাড়ও করতে পারবেন না কোনদিন।’’
সেলিম বলেন, ‘‘ক্রমাগত জটিলতা বাড়াচ্ছে সরকার। এখন আধার বাতিলের কথা বলছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তুলছেন মানুষ। মানুষ কি শান্তনু ঠাকুরের দেওয়া কার্ড নিয়ে ঘুরবে? সেটাই হবে তাঁদের পরিচয়পত্র? মনে রাখতে হবে, বাংলাভাষার মানুষ দেশের সরকারের কাছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া বাংলার মানুষ তাদের কাছে বাংলাদেশী। তাদের উদ্দেশ্য, কাগজপত্র না থাকলেই মানুষকে উচ্ছেদ করা। এর বিরুদ্ধে মানুষকে আরও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।’’
এদিন বক্তব্য রাখতে গিয়ে রামচন্দ্র ডোম বলেন, সরকারের অঙ্গুলিহেলনে সংবিধানে লিখিত মানুষের মৌলিক প্রশ্নগুলিই বাদ পড়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের অধিকারের প্রশ্ন অস্বীকার করা হচ্ছে। দেশের এবং রাজ্যের শাসক যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই নাগরিকত্ব নিয়ে সরব হয়েছে—তা এখন সামনে আসছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধের আন্দোলন আরও জোরদার করতে হবে।’’
সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত লড়াইতে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া যাবে না। এই সমস্যা শুধুই উদ্বাস্তু, সংখ্যালঘু, মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের নয়, এই সমস্যা প্রতিটি গরিব মানুষের। সমস্যা তৈরি করা হয়েছে। যেমন দেশভাগের শিকার হয়েছিলেন অনেকে। বাংলাকে ভাগ করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ভারত ভাগ হয়েছিল। রাষ্ট্র সে সময়ে কোন দায়িত্ব নেয়নি ওই উদ্বাস্তুদের। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির দল উৎসাহী হয়েছিল, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি সে সময়ে এর বিরোধীরা করেছিল। পরে উদ্বাস্তুরা অনেক লড়াই করে অধিকার অর্জন করেছিলেন, লাল ঝান্ডা তাঁদের সেই শক্তি দিয়েছিল।’’ তিনি বলেন, ‘‘২০০৩ সালে এনডিএ সরকারের আমলে এই চক্রান্তের শুরু। তখন মমতা ব্যানার্জির দল ছিল এনডিএ সরকারের শরিক। আইন সংশোধন করে দেশভাগ হয়ে ভারতে আসা প্রায় সমস্ত মানুষকে ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। আর অন্যদিকে, এরাজ্যে উদ্বাস্তু মানুষকে অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়ার দাবি করে তৃণমূল। আমরা স্পষ্ট বলছি, নথিপত্র চেয়ে গরিব মানুষকে বিপদের মধ্যে ফেলা যাবে না।’’
অমিয় পাত্র বলেন, ‘‘ভোট এলে নড়েচড়ে বসে শাসক দল। সবাই নিজেদের হাজির করে, জাহির করে। সাধারণ মানুষের বক্তব্য চাপা পড়ে যায়। তাঁরা যাবেন কোথায়? এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন হল আমাদের পরিচয় নিয়ে। বছরের পর বছর ধরে এ দেশে বাস করা কত মানুষের কোনও কাগজপত্র নেই নাগরিকত্ব প্রমাণের।’’
এদিন কনভেনশনে ৬ দফা প্রস্তাব রাখা হয়। বাংলার মানুষকে বে-নাগরিক করার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে, দরখাস্ত এবং নথিপত্রের নামে মানুষকে ঠকানো চলবে না। নাগরিকত্ব আইন ২০০৩-এর সংশোধনীর নির্দিষ্ট ৩টি বিপজ্জনক ধারা বাতিল করতে হবে। ধর্মীয় অত্যাচারের ফলে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়া হতে হয়েছে, এমন প্রমাণপত্রের আবশ্যিকতা রাখা চলবে না। এই সংক্রান্ত পাসপোর্ট আইন ও ফরেনার্স আইনের সংশোধনী বাতিল করতে হবে। নাগরিকত্ব বিষয়ে অনিশ্চয়তা রেখে নাগরিক পঞ্জি হতে পারবে না। এছাড়া ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বা তার পরের কোনও তারিখকে ভিত্তিবর্ষ স্থির করে তার আগে থেকে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সবাইকে ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।
Md Salim
নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও হকই নেই মোদী, মমতা সরকারের: সেলিম
×
Comments :0