রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করে হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ যে রায় দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে রাজ্য সরকার, স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। সেই আবেদনের শুনানি হবে সোমবার। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের এজলাসে এই মামলার শুনানি হওয়ার কথা আছে। কেলেঙ্কারির কাদায় মাখামাখি হওয়া তৃণমূল সরকার এখন সুপ্রিম কোর্টে সময় কিনে লোকসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চাইছে।
কলকাতা হাইকোর্টে মামলা চলাকালীন স্কুল সার্ভিস কমিশন যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের যোগ্যতা প্রমাণে এবং যোগ্য-অযোগ্যদের সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণে কোনও তথ্য দিতে পারেনি বলেই আদালতকে পুরো নিয়োগ বাতিল করতে হলো, বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ সাব্বার রশিদি তাঁদের রায়ে এই কথাই বলেছিলেন। রায়ের নির্দেশ অনুযায়ী, নিয়োগ বাতিলের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতদের থেকে ১২ শতাংশ সুদ সহ বেতন ফেরতের কোনও প্রক্রিয়াই স্কুল সার্ভিস কমিশন, শিক্ষা দপ্তর এবং জেলা প্রশাসন এখনও শুরু করেনি। নির্বাচনী প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী এখনও বলে বেড়াচ্ছেন, কারও চাকরি যাবে না, রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। অর্থাৎ হাইকোর্টের রায় সত্ত্বেও খাতায়-কলমে এখনও শিক্ষকরা স্বপদেই বহাল আছেন। তাঁদের নামের তালিকাও নির্বাচন কমিশনের কাছে স্বাভাবিক নিয়মে পাঠানো হয়েছে এবং তার ফলে নির্বাচন কমিশনও বরাবরের মতো এবারও তাঁদের নির্বাচনী ডিউটিতে নিয়োগ করেছে। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিকত্ব না থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী থেকে শিক্ষা মন্ত্রী এখন যা পারছেন, তাই দেখিয়েই নজর ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। ব্রাত্য বসু তাই এদিন বোলপুরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘আমাদের প্রশ্ন, হাইকোর্টের নির্দেশে যাঁদের চাকরি নেই, ভোট কর্মী হিসাবে তাঁরা কাজ করছেন কী করে! তাহলে নির্বাচন কমিশন তাঁদের অযোগ্য মনে করেনি! এই পয়েন্টটা আমরা সুপ্রিম কোর্টে জানাবো।’’
স্কুল সার্ভিস কমিশন আর রাজ্য সরকারের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টে এমন ‘ধারালো যুক্তি’ নিয়ে লড়াই করে ২৫ হাজার শিক্ষকের চাকরি রক্ষা করবেন? না কি ভোটের বাজারে রাস্তার ভাষণ আর আদালতে শুনানির নামে কোটি কোটি টাকা খরচে নির্বাচনের সময়টুকু পার করা হবে? সুপ্রিম কোর্টে শুনানি গড়ালেই সেকথা বোঝা যাবে বলে আইনজ্ঞদের ধারণা।
মুখ্যমন্ত্রী প্রতি নির্বাচনে বরাবর প্রচার করে এসেছেন যে, সব কেন্দ্রে তিনিই প্রার্থী, সব সমস্যার সমাধানে তিনিই দায়বদ্ধ। সরকারি সব দপ্তরও বরাবর প্রতিটি পদক্ষেপে মুখ্যমন্ত্রীর ‘অনুপ্রেরণা’র কথা উল্লেখ করে দিয়ে এসেছে। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতিতে হাইকোর্টের রায়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী নিজের ঘাড় থেকে দায় এড়াতে বলেছেন, সব কিছু তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। একইভাবে রবিবার বীরভূমের বোলপুরে শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘‘এসএসসি স্বশাসিত একটা সংস্থা। কীসের ভিত্তিতে তারা যোগ্য-অযোগ্য বিচার করেছে, সেটা আমি বলতে পারব না। তারাই বলতে পারবে।’’ অথচ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ থেকে শুরু করে এসএসসি সব কিছুতেই তৃণমূলীদের বসিয়ে দুর্নীতিতন্ত্র কায়েম করার সময়ে সরকার এবং তাদের শিক্ষা দপ্তর যে সক্রিয় ছিল, সেটা তিনি স্বীকার করেননি। দুর্নীতির কারণে চাকরি বাতিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা শীর্ষ আদালতে গিয়েছি। সেই রায়ের অপেক্ষায় আছি। এইভাবে এত জনের চাকরি বাতিল করা যায় না।’’
এক সপ্তাহ আগেই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহম্মদ সাব্বার রশিদির ডিভিসন বেঞ্চ ২০১৬ সালের এসএসসি’র পুরো প্যানেলের মোট ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দেয়। হাইকোর্টের নির্দেশে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, স্কুল সার্ভিস কমিশনকে দিয়ে অবৈধভাবে শিক্ষক পদে নিয়োগ করা হয়েছিল এমন বহু জনকে, যারা ওএমআর শিটে যোগ্যতার কোনও নজিরই রাখতে পারেনি। সুপার নিউমেরিক পদের নামে বেআইনি নিয়োগও করা হয়েছে সরকারি নির্দেশে। অবৈধ নিয়োগে সোজাসুজি নবান্ন তথা মন্ত্রীসভার দিকেও আঙুল তুলেছে হাইকোর্ট। নিয়োগের নামে কোটি কোটি টাকার খেলার যে অভিযোগ এত দিন বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা করে আসছিলেন, তা এখন আদালতে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। ১৭টি পয়েন্ট তুলে ধরে আদালত কীভাবে বেআইনি পথে নিয়োগ হয়েছে, তাও তুলে ধরেছে। আদালত সিবিআই-কে এই অপরাধের তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলেছে। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগ বাতিল হয়ে যাওয়া শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরাও বিপদে পড়েছেন। কারণ, হাইকোর্ট বারবার জানতে চাওয়া সত্ত্বেও স্কুল সার্ভিস কমিশন যোগ্য এবং অযোগ্য শিক্ষকদের পৃথকীকরণের কোনও তথ্যই দিতে পারেনি। রাজ্য সরকার এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন নিয়োগ দুর্নীতির মাত্রা এবং তার পিছনের মাথাদের আড়াল করতে গিয়ে স্রেফ বলি দিয়েছে দুর্নীতির আশ্রয় না নিয়ে নিযুক্ত হওয়া শিক্ষকদেরও। এর ফলে শুধু চাকরি হারানো শিক্ষকরাই বিপদে পড়েননি, রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাও চরম বিপদে। স্কুলগুলিতে শিক্ষকের শূন্যতায় আদৌ পঠনপাঠন চালু হবে কী করে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কলকাতা হাইকোর্টে শুনানি চলাকালীন এই পুরো সমস্যার সমাধানের কোনও চেষ্টা না করলেও এখন লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন নিয়োগ কেলেঙ্কারির থেকে দায় এড়াতে রাজনৈতিক অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, সঙ্গে তৃণমূলের অন্য নেতা-নেত্রীরাও। সুপ্রিম কোর্টকে দেখিয়ে তারা কোনওরকমে মিথ্যা প্রচারে সময় কাটিয়ে লোকসভা নির্বাচন পার করতে চাইছে। কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত মূল সমস্যার সমাধান হবে, এমন কোনও ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে চাকরি যাওয়ার জন্য কখনও বিরোধীদের দায়ী করছেন, কখনও আদালতকে দায়ী করছেন। কিন্তু দুর্নীতির জন্য দায়ীদের কথা তিনি মুখেও আনছেন না। এই পরিস্থিতিতে চাকরি হারানো শিক্ষক এবং চাকরি না পাওয়া বঞ্চিত প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের পারদ চড়ছে, রাজ্যের সাধারণ মানুষও শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের লক্ষণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বহু জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে, বিধাননগরের করুণাময়ীতে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের হামলাও হয়েছে।
Comments :0