Banaras

হারিয়ে যাচ্ছে চির চেনা বেনারস

জাতীয় ফিচার পাতা

জয়ন্ত সাহা 
 

বার্ধক্যের বারাণসীতে এখন খুঁজতে গিয়ে অনেক কিছুই আর মেলে না! নেই দশাশ্বমেধ ঘাটের সেই ফেলুদার গন্ধমাখা নস্টালজিয়া, এখন সেখানে লেগেছে কর্পোরেটের আধুনিকতার ছোঁয়া, রানি রাসমণির সেই ঘাটে পেল্লাই বাড়ি আর বাঙালি বিধবাদের আশ্রয়স্থল নয়, এখন নরেন্দ্র মোদীর সৌজন্যে সেটা বেসরকারি হোটেল। বেনারসের বাঙালি টোলা খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেতেই হবে।
এক সময়ে কালীতলা থেকে গোধূলিয়া চৌরাস্তা হয়ে  একেবারে কেদারঘাট পর্যন্ত এলাকাটিকেই সারা দুনিয়ার মানুষ ‘বাঙালিটোলা’ হিসেবেই চিনত। বাঙালিটোলা এখন হাতের তালুর মত ছোট্ট হয়ে গেছে। আর যা হারিয়ে যেতে বসেছে তাহল বেনারসী শাড়ির শিল্প! নিশ্চয়ই চমকে উঠছেন তো পাঠক! এটাই এখন বাস্তব। ২৫-৩০ বছর আগেও বেনারস শহরের আশেপাশের গ্রামের অন্তত ৭০ হাজার মানুষ বেনারসী শাড়ি তৈরির কাজে জড়িয়েছিলেন। এখন সেই সংখ্যাটি কমতে কমতে হাজার সাতেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ওস্তাদেরা জানান, ‘আরো কমে যাবে।’ কারিগরদের হাতের কাজের খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। আজও বিদেশ থেকে আসা পর্যটকেরা বেনারসে এলে দোকানে গিয়ে বেনারসী শাড়ি অথবা চুড়িদার পিস নিদেন পক্ষে ওড়না কিনে গায়ে জড়িয়ে এঘাট সেঘাট কিংবা সারনাথে ঘুরে বেড়ান।
সেই বেনারসী শিল্প ধুঁকছে! দশাশ্বমেধ ঘাটে নামার ঠিক আগেই ডান হাতের উঁচু বাড়িটিতে সন্ধ্যা আরতির সময়টুকু বাদ দিলে সারাক্ষণ বেনারসী শাড়ির বিভিন্ন প্রচার চলছে মাইকে। উদ্যোক্তা রাজ্য সরকার। গোধূলিয়া চক থেকে শুরু করে আরশি ঘাট কিংবা দূরের সারনাথ, যেখানেই যাওয়া যাক বেনারসীর বিজ্ঞাপন পর্যটককে কাছে টানবেই। এই বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ী,সমবায় আর সরকারের। সোনালি দিনের গল্প হয়ে বেঁচে আছে বেনারসের ঐতিহ্যের বেনারসী। শিল্পের কংকালসার চেহারাটা দেখতে হলে যেতে হবে গান্ধীচক, খোঁজবা, বেনারস সিটি স্টেশনের চারপাশের অস্বাস্থ্যকর মহল্লা বা আলোয়াপুরা,কিংবা বাকারিয়া কুন্ড এলাকায়। 
সারনাথে দেখা হয় বেনারসী কারিগর বছর ৭০’র আলি মুন্না মাস্টারের সাথে। ‘মাস্টার’ নামেই এলাকার সবাই ডাকেন তাঁকে। মুখে পান পুরে বেনারসী বোনা তাঁতের সামনে বসে শোনালেন, এক সময়ে হ্যান্ডলুমেই বোনা হত বেনারসী। এখন পাওয়ারলুম এসেছে, আছে স্যাটারলুম। আলি মুন্না মাস্টারের আপশোষ বাপ ঠাকুর্দার পর আমি মাস্টার হয়েছিলাম। আমিই হয়ত আমাদের বংশের শেষ মাস্টার! কারণ দুই ছেলের কেউই আর একাজ করতে রাজি নয়। তারপর নিজেই বললেন, ‘এ কাজ করে লাভই বা কি!’ দিনের শেষে হাতে মেলে ৭০০টাকা। কেবল আলি মুন্না মাস্টারের ছেলেরাই নয়,ওঁর সহযোগীরা শিল্পী তকমা ছেড়ে এখন কেউ সুরাট, কেউ কেরালায় কাজ করেন।
তবে বেনারসীর কাজের সাথে জড়িতদের বেশির ভাগের গন্তব্য সুরাটের কাপড়ের মিল। সালাউদ্দিন, কায়ুম, বিজয় রাজভর, গুলাব রাজভরেরা কেরালায় গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। আলি মুন্না মাস্টার ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন, গুলাব রাজভরের সঙ্গে। বেনারস ছেড়ে যাবার জন্য মন খারাপ লাগে না? গুলাবের জবাব,‘বাড়ির জন্য মন খারাপ হলে কি আর করব! যখন বেনারসি শিল্পী ছিলাম তখন সারাদিন কাজ করে পেতাম ৩৫০ টাকা। আর এখন শ্রমিক হয়ে কেরলায় পাচ্ছি  ৯০০ টাকা। 
বেনারসী শিল্পের সাথে জড়িয়ে থাকা আরেক মাস্টার সাদেক আলি। প্রায় ৪৫ বছর ধরে শাড়ি তৈরি করছেন।তিনি জানালেন,বেনারসি তৈরির জন্য তো কোনো কারখানা নেই।দূরের দূরের গ্রামে কারুর বাড়িতে দুটো কারুর বাড়িতে তিনটে তাঁত আছে।কেউ মহাজনের থেকে সুতো এনে কাজ করে জমা দেয় মহাজনকে।কেউ কেউ আবার নিজেরাই শাড়ি বানিয়ে বিক্রি করে মহাজনের কাছে।বছর ৬৫ র সাদেক আলিও বলছে, বড় জোর আর ২০/২৫ বছর  টিকে থাকবে এই শিল্ল।তারপর মাস্টারেরা হারিয়ে গেলে কে শেখাবে ভিন রাজ্য থেকে সিল্ক এনে কী করে বেনারসী তৈরি করতে হয়।
সাদেক আলি বলেন, এক সময়ে মুম্বাই, গুজরাটের বড় ব্যবসায়ীরা তাদের এলাকায় বেনারসী শাড়ি বানাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কারিগরের অভাবে আর তৈরি করা হয়নি। বছর ২০র মধ্যে বেনারসেও আর বেনারসী হবে কিনা সেই আশঙ্কা করছেন মাস্টার সাদেক আলির মত ব্যক্তিও। পঞ্চগঙ্গা ঘাটের সামনে বড় বট গাছের ছায়ায় বসে টোটো চালক মহম্মদ নিসার জিরিয়ে নিচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলাপ জুড়তেই বলেন, এখন টোটো চালাই ঠিকই। লকডাউনের আগেও আমি বেনারসীর কারিগর ছিলাম। বয়ে যাওয়া গঙ্গার দিকে আঙুল তুলে বলেন, ওই ওপারে চরের দু’কিমি হেঁটে গেলেই আমাদের গ্রাম। আগে প্রায় সব ঘরেই বেনারসীর কাজ হত। এখন বড়ো জোর ২৩/২৪ ঘরে কাজ হয়। বাকি সবাই অন্য পেশায় চলে গেছে। বাপ-ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি, প্রায় ৪০০ বছর আগে দুর্ভিক্ষের সময় গুজরাত থেকে রেশম তাঁতিরা বেনারসে এসে বসতি গড়ে এখানে। তখন বেনারসীতে সোনা ও রুপোর সুতো দিয়ে কারুকাজ করা হত। একটা সময় আসে যখন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরাই দক্ষ হয়ে ওঠে বেনারসী তৈরিতে। বেনারস থেকে দেশ ভাগের সময়ে কিছু কারিগর ঢাকায় চলে গিয়েছিল। সেখানেও এখন বেনারসী তৈরি হয়। বাবার মুখে শুনেছি বাংলাদেশের মীরপুরে আমাদের বংশধরদের কেউ কেউ রয়েছেন।
বেনারসী বিক্রেতা নূর আলি বেনারসের গলিতে বড় দোকানের মালিক। ১০০ বছরের বেশি পুরানো দোকান। বাঙ্গালি খদ্দের সামলে জানান, মূল বেনারসী শাড়ি মানবচালিত যন্ত্রে তৈরি হয়। শাড়ি তৈরির প্রক্রিয়া বেশ জটিল। রেশম সুতো বেনারসে হয় না। ভিন রাজ্য থেকে আসে সুতো। আসে বিদেশ থেকেও। সহজ বুননে একটা বেনারসী শাড়ি তৈরি করতে এক সপ্তাহ সময় লাগে। আর কঠিন ডিজাইনের নান্দনিক শাড়ি বুনতে তিনজন কারিগরের তিনমাসের বেশি সময় লাগে। নূর আলি জানান, চোস্ত হিন্দি বললেও তাঁরা বাঙালীই। আদি বেনারস, ঝিয় মদনপুরা, বড়িবাজার, সোনারপুরা, চৌকিঘাট, পানিট্যাঙ্কি এলাকায় এখনও অল্পকিছু বাঙালি কারিগরের দেখা মেলে। বেনারস জুড়ে জনা ৫০ বাঙালি ব্যবসায়ী আছেন। তাদের মধ্যে সিংহভাগই মুসলিম। কারিগরদের মধ্যেও তাই। 
বেনারসের যে সব মহল্লায় তাঁতে বেনারসী বোনা হয় তাদের একটাই হাহাকার, হাতে চালানো তাঁতের জায়গা দখল করে নিয়েছে যন্ত্র। এখন প্রচুর বেনারসী শাড়ি একসাথে তৈরি  হলেও গরিমা হারাচ্ছে বেনারসী। জংলা, বেল স্যাটিন, কড়িয়াল, জামেবার, স্বর্ণকাতান, চান্দেরী অরগাঞ্জা কাতান, পাটোলা, জুটকাতান কিনলেও ক্রেতা বুঝতেই পারবে না সেগুলি যন্ত্র তাঁতে বোনা।
সিউ সোনকর, হেমরাজ সোনকরদের মত অনেকেই এখন আর বেনারসীর কারিগর নন। ওরা দুজনেই এখন অসংগঠিত শ্রমিক। মোদীজী, কিংবা যোগীজী কি ওদের জন্য কিছুই করেনি? এই প্রশ্ন রাখতেই ওরা উলটো পথে হেঁটে দ্রুত চলে গেল। বুঝতে এতটুকু কষ্ট হল না, এতদিনের পুরানো পেশা হারিয়ে গেলেও মুখ খোলার ঝক্কি কেউই নিতে রাজি নয়। সাংসদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে যদি বিপদে পড়েন!
 

Comments :0

Login to leave a comment