প্রবাদে আছে আদার ব্যাপারির জাহাজের খোঁজ নেবার শখ। ধর্মান্ধ হিন্দুত্বের তাল পুকুরে হাঁটু ডোবানো কূপমণ্ডুকরা এসেছে বিশ্ববীক্ষার সাত সমুদ্র অতিক্রম করা এক মহামানবের খিড়কির দরজায় টোকা মারতে। কাকের দেহে ময়ূরের পেখম লাগালে তো আর কাক ময়ূর হয়ে যায় না, কাক কাকই থাকে।
অমিত শাহরা যতই রবীন্দ্র ভজনা করুন না কেন রবীন্দ্র চেতনা বা রবীন্দ্র আদর্শের কূল পাওয়া তাদের কম্ম নয়। ঢাক ঢোল পিটিয়ে যতই নৈবেদ্য সাজান না কেন সচেতন চাতুরিতে সজ্জিত সেই নৈবেদ্য খণ্ডিত, আংশিক ও অসম্পূর্ণ আদর্শেরই বিকৃত প্রকাশ ঘটছে। লোক দেখানো কবি প্রণামের আড়ালে বিদ্বেষ-বিভাজনের কারিগররা মনুবাদের কুয়োতেই পাক খাবে। রবীন্দ্র চেতনার ত্রিসীমানাকে স্পর্শ করার সক্ষমতা তারা কোনোদিনই অর্জন করতে পারবে না।
কবির বিশ্ববীক্ষা, বহুত্বের মধ্যে মিলনের আকুতি, দেশকালের সীমার বাইরে বিশ্ব মানবতার উন্মুক্ত আঙিনার খোঁজ তারা কোনোদিনই পাবে না। গান্ধীর গলায় মালা দিয়ে নাথুরামকে মাথায় তুলে নাচে যে মতাদর্শ তা রবীন্দ্র চেতনার কাছে অচ্ছুৎ-অস্পৃর্শ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই বিশ্ব কবিকে নিয়ে মোদী-শাহদের এহেন ধ্যাষ্টামি না করাই ভালো।
রবীন্দ্র রচিত ভারতের জাতীয় সঙ্গীতকে যারা প্রকাশ্যে প্রবলভাবে অস্বীকার করার কথা ঘোষণা করে ক্ষমতার রাজনীতির ময়দানে তারা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে বাংলার হৃদয় স্পর্শ করতে হলে আগে রবীন্দ্র নাথের কাছে নতজানু হতে হবে। বাংলা ও বাঙালির আত্মচেতনার মর্মে মর্মে জড়িয়ে আছে রনীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্র চেতনার সাথে আত্মচেতনার মিলন ঘটাতে যারা অপারগ বাংলা তাদের ঠাঁই দেয় না। তেমনি বঙ্গে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বৈরিতা ও বিদ্বেষের যিনি অন্যতম হোতা সেই শ্যা মাপ্রসাদ যাদের পরম আরাধ্য রবীন্দ্র মননের উদার আকাশে তারা একান্তই বেমানান ।
বাংলার হৃদয় স্পর্শ করতে এর আগে তারা বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু হজম করতে পারেনি। শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলনে হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করার সুবাদে হিন্দুত্ববাদীরা ভেবেছিল বিবেকানন্দকে তাদের আইকন বানাবে। কিন্তু ধর্মের নামে অনাচার, ধর্মান্ধতার অমানবিকতার বিরুদ্ধে বিবেকানন্দের মুখরতা, গোমাতার সন্তানদের নাজেহাল করার কথা সামনে চলে আসায় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
একইভাবে বিদ্যাসাগরকে ধরতে গিয়েও হাত পুড়িয়েছে গেরুয়া বাহিনী। অগত্যা রবীন্দ্রনাথ ধরে বাংলায় জমি পাবার শেষ চেষ্টা।
সঙ্কীর্ণ ও সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কূট কারবারিরা বোঝে না রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করা অনেক বেশি দুরূহ। হিন্দুত্ববাদের প্রতিটি অভিমুখ কঠোর দেওয়াল তুলে রেখে রবীন্দ্র আদর্শ। ভারত ভাবনার পরতে পরতে দৃঢ় অবস্থান রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু সেখানে কোথাও নেই হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবক্তারা।
রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস চেতনা, ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য, জাতীয়তাকে পেছনে ফেলে বিশ্বজাতীয়তায় উত্তরণ, প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষকে এক সুরে ও ছন্দে গাঁথা, ধর্ম-ভাষা-বর্ণ-জাত-সম্প্রদায়-সংস্কৃতির আশ্চর্য বহুত্বের মধ্যে মিলনের সেতু নির্মাতা, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ব মানবতার জয়ে আমোদিত কবির কোনও কিছুর সঙ্গেই মিল নেই সঙ্ঘ পরিবারের ভাবনার। তাই রবি বন্দনার নামে ভণ্ডামির আশ্রয় না নেওয়াই ভালো। গেরুয়া শঠতা আর রবীন্দ্র চেতনার অবস্থান বিপরীত মেরুতে। ভণ্ডামি ধরতে কারো অসুবিধা হবে না।
Comments :0