Irfan Habib Interview

সাম্প্রদায়িকতা দেশপ্রেম নয় বললেন ইরফান হাবিব

জাতীয়

সাম্প্রদায়িকতা দেশপ্রেম নয়। তা সে যে ধর্মেরই হোক। একটি হিন্দি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে এ কথা বলেছেন ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব। বৃহস্পতিবার সাক্ষাতকারটি সম্প্রচারিত হয়েছে। দেশের নানা অংশে নতুন করে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বিতর্ক বাঁধানো হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সাক্ষাতকারটি গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে তিনি বলেছেন ভারতের অতীত সহনশীলতার কথাই বলেছে। 

ইরফান হাবিব বলেছেন, ঠিক-ভুল না বুঝে শুধু নিজের দেশের সুখ্যাতি করে যাওয়াটা দেশপ্রেম নয়। আমার দেশের আরও ভালো করতে হবে- এটা দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের প্রথম শর্তই তো হলো, দেশের মানুষের সেবা করা। দেশের মানুষের একাংশকে পৃথক করে রাখো, তাদের উপরে অত্যাচার করো, এটা তো দেশপ্রেম নয়। সাম্প্রদায়িকতা কোনো দেশপ্রেম নয়, সেটা হিন্দুদের মধ্য হোক বা মুসলিমদের মধ্যে অথবা অন্য কোনো ধর্মের। আমাদের ইতিহাসকে যদি ঠিক করে পড়া যায়, তাহলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে কার কী অবদান রয়েছে। 

হিন্দুত্ববাদীদের দিক থেকে বরাবরই আওরঙ্গজেবকে অত্যাচারী, হিন্দুবিরোধী শাসক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেই বিকৃত ভাষ্যকেই ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। এমনকি ঐতিহাসিক তথ্য সহ আওরঙ্গজেব সম্পর্কে কথা বললেও দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া হচ্ছে, পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কোনো ছোটখাটো হিন্দুত্ববাদী নেতা নয়, মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকা দায়িত্বশীলরা এমন কথা বলছেন। মহারাষ্ট্র বিধানসভা থেকে এক বিধায়ককে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছে এই কারণে যে, তিনি শুধু বলেছেন আওরঙ্গজেব হিন্দু বিরোধী ছিলেন না। একইরকম আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে বিহারে শাসক দল জেডি(ইউ)-র এক বিধায়ককে। একটি ভাষ্য দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করা হয়েছে যে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ এবং মার্কসবাদী ইতিহাসবিদরা ইচ্ছাকৃতভাবে অশোক এবং মুঘল শাসকদের মহান বানিয়েছে। হিন্দু রাজাদের সেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তার জেরে বর্তমানে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য থেকে এদের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সব বিষয় নিয়ে এদিন বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ইরফান হাবিব। 

হাবিব বলেছেন, অশোক তাঁর শিলিলিপিতে অনেক কথা বলে গেছেন যে কী করা উচিৎ। তারমধ্যে তিনি বলেছেন, অসহিষ্ণুতা একেবারেই থাকা উচিৎ নয়। অশোকের ধর্ম সম্পর্কে যে ধারনা তা সম্পূর্ণ সহনশীলতার উপরে প্রতিষ্ঠিত। তিনি অন্য ধর্মের সম্মানের কথা বলেছেন। অশোকের ধম্মে কোথাও জাতপাতের কথা নেই। যে বিষয়টি প্রায়শই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। মনুস্মৃতি বা গুপ্তযুগের শিলালিপি দেখলে কোথাও এটা দেখা যাবে না। এখন ইউজিসি’র সিলেবাসে অশোকের সামান্যই উল্লেখ আছে। অথচ অশোক পুরো ভারতে লিপির প্রসার করেছেন। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। 

ইরফান হাবিব বলেন, দুনিয়াতে যখন হিন্দুস্তান নিয়ে আলোচনা হয়, অশোক এবং আকবরের কথা বলা হয়। আওরঙ্গজেবকে লেখা একটি চিঠিতে শিবাজী বলেছিলেন, আপনার আকবরের নীতি অনুসরণ করা উচিৎ। শিবাজীর সমগ্র কাজকর্মে কোথাও ধার্মিক অসহিষ্ণুতা ছিল না। ধর্মের নিজস্ব জায়গা ছিল কিন্তু সরকারের যে নীতি ছিল, সেটাকে আজকের ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষই বলা উচিৎ। এই প্রসঙ্গেই হাবিব বলেন, বুদ্ধ ধর্ম যখন এলো, পাঁচ-সাতশো বছর তা প্রভাবশালী ছিল। তার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদের সংঘর্ষ তো ছিলই। ভারতের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের সংঘর্ষ থাকলেও সাধারণভাবে সহনশীলতা ছিলই। 

আওরঙ্গজেব নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওরঙ্গজেবের সময়ে যত বিদেশী পর্যটক এসেছেন, তাদের লেখায় কোথাও পাওয়া যায় না যে এটা অসহিষ্ণু দেশ। তাদের একজনেরও মনে হয়নি যে এখানে হিন্দুদের উপরে অত্যাচার হচ্ছে, যদিও জাজিয়া কর ছিল। তবে বৃন্দাবন নথিপত্র থেকে দেখা যায় যে তা বেশিরভাগই আদায় হতো না, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। বিদেশী পর্যটকরা বিস্মিত হয়েছেন যে, এখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সব ধর্মের লোক শান্তিতে আছেন। যা ইউরোপেও ছিল না। ভারত ছাড়া ইরান ইত্যাদি দেশেও ছিল না, সেখানে শুধু মুসলমান ছিল। আওরঙ্গজেবকে নিয়ে আমরা অনেক সমালোচনা এখন করতে পারি। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময়েও সহনশীলতা ছিল। এ তো আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমরা এর জন্য গর্ববোধ করি না এটা আমার আশ্চর্য লাগে। 

দুনিয়ার যে কোনো দেশের ইতিহাস পড়তে গেলে তার সংস্কৃতি দেখা হয়। তার মধ্যে যুক্তিবাদ কতটা আছে তা বিবেচনা করা হয়, মনে করে দিয়েছেন প্রবীন ইতিহাসবিদ। এই প্রসঙ্গেই তিনি আকবরের সময়ের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আকবরের সময়ে তো এই আশ্চর্যরকমের যুক্তিবাদ ছিল। আকবরের সময়ে বসে আবুল ফজল ইসলামের ইতিহাস নিয়ে সমালোচনা করে বলছেন, এটা ভুল হয়েছে। ধর্মের কী অধিকার ছিল শাসন করার! তা নিয়ে ওই সময়ে উলেমারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বাদশাহর মন্ত্রী এই কথা বললে কার কী করার হিম্মত ছিল। মহারানা প্রতাপ, মান সিংয়ের ইতিহাস কীভাবে লেখা সম্ভব যদি আকবরের কথাই বলা না হয়? মুঘল আমল না বলে কীভাবে বলা যাবে যে মান সিংকে কাবুলের প্রথম গভর্নর করা হয়েছিল। রাজপুত মান সিংকে আফগানিস্তানের কাবুলের গভর্নর করে দেওয়া হয়েছিল, এটাই ঐতিহাসিক সত্য। শাহজাহানের সময়ে সব ধর্ম নিয়ে একটি বই লেখা হয়েছিল ফার্সিতে, ‘দাবিস্তান-ই-মজাহিব’। তাতে পার্সিয়ান, ইসলাম, শিখ, বৌদ্ধ, হিন্দু সব ধর্মের কথা লেখা ছিল। ঊনিশ শতকে যখন এটার অনুবাদ হলো, অনুবাদক বলেছিলেন এটা অনন্য। অর্থাৎ আমাদের এমন একটা সংস্কৃতি ছিল, যা সহনশীল। সেই কথা যদি না বলা হয়, তাহলে তো আমাদের দেশের গুরুত্বই কমে যায়। এই সব তো আমাদের কৃতিত্ব, তা আমরা ভুলে যাচ্ছি। 

এই সব উদাহরণ তুলে ধরে ইরফান হাবিব বলেছেন, মুঘলদের যদি আমাদের অতীত থেকে বের করে দেওয়া হয়, যদি কখনও তাদের উল্লেখই না হয়, তাহলে ইতিহাসে হিন্দুস্তানের যে মূল্য সেটাই কম হয়। ক্ষতি আমাদের হয়, অন্য কারোর তাতে লোকসান হয় না। আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেছেন, মনে হয় আজকে রাষ্ট্রের যে মতাদর্শ, তাতে এর কোনো জায়গাই নেই। বিভিন্ন জায়গার নাম পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সাম্প্রদায়িক কারণে নাম পরিবর্তন অন্যায়। এই প্রসঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, আলিগড় নাম মারাঠাদের দেওয়া। বর্তমানে যা পরিবর্তন করতে চাইছে যোগী সরকার।

ইউজিসি’র বর্তমান সিলেবাসকে পরিহাস বলে সমালোচনা করেছেন হাবিব। তিনি বলেছেন, একদিকে বলা হচ্ছে মুসলমান সঙ্গে করে জাতিবাদ নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে মনুস্মৃতি আর কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকে বলা হচ্ছে ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থার আধার। ভারতের জ্ঞান ব্যবস্থাকে মনুস্মৃতি আর কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মধ্যে সীমিত করে দেওয়া হবে? দুটিতেই জাতিবাদ ছাড়া আর কী আছে? তা কখনও ভারতীয় মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে? ভারতীয় মতাদর্শ কারণ, যুক্তিবাদ এবং সমতার উপরে প্রতিষ্ঠিত।

Comments :0

Login to leave a comment