EDITORIAL

গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্র জবাই

সম্পাদকীয় বিভাগ

হিন্দুত্ববাদের প্রবল স্বৈরাচারী আগ্রাসনের মুখে ‘গণতন্ত্রের জননী’র দেহ রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হলেও জনপরিসরে সেটা উচ্চারণ করা যাবে না। বিরোধিতা বা সমালোচনা তো কোনো অবস্থাতেই নয়। হিন্দুত্বের আধারে সংখ্যাগুরুবাদের কাঠামোয় গণতন্ত্রের যে মূর্তি নির্মাণ করার চেষ্টা চলছে সেখানে এহেন সমালোচনা নিতান্তই গর্হিত কাজ। গণতান্ত্রিক পরিসরের জন্য কথা বলা যাবে তবে অবশ্যই আধুনিক উদারগণতন্ত্রের জন্য নয়। নাগপুরের হিন্দুত্ববাদী কর্মশালায় নির্মিত গণতন্ত্রের চৌহদ্দির মধ্যেই আটকে রাখতে গণতান্ত্রিক অধিকার। হিন্দুত্ববাদীদের গণতন্ত্র আসলে সংখ্যাগুরুবাদের আধিপত্যকামী স্বৈরতন্ত্র। মোদী জমানায় ভারতের বুকে এহেন গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণারই প্রসার ঘটানোর চেষ্টা চলছে। তেমনি এমন গণতন্ত্রেরই জননী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে ভারতকে। যে গণতন্ত্রের কথা আধুনিক বিশ্ব জানে এবং অনুসৃত হয় ভারতের বর্তমান শাসকরা সেই গণতন্ত্রকে মানে না। গণতন্ত্রেরই এক বিকৃত অবয়ব খাড়া করে তাকে গণতন্ত্রের নামে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে।


গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, সমালোচনা বা বিরোধিতা করার অধিকার। গণতন্ত্রের সর্বজনের মানবাধিকার স্বীকৃত। গণতন্ত্রে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতির কোনো বিভাজন রেখা থাকে না। তেমনি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসক দলের মতো সমস্ত বিরোধী দলও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সংসদে মত প্রকাশের, কথা বলার, বিরোধিতা বা সমর্থন করার অধিকার সব সাংসদের সমান। সরকার পক্ষের হলে বেশি সুযোগ বেশি অধিকার এমনটা গণতন্ত্রে বিধানে নেই। গণতন্ত্রের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অপরিহার্য শর্ত স্বচ্ছতা। গণতন্ত্র নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যা গরিষ্ঠদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে বটে কিন্তু সেখানে কোনো গোপনীয়তা বা অস্বচ্ছতা চলে না। সরকার কি করছে, কিভাবে করছে তার সবটাই জানার অধিকার দেয় গণতন্ত্র।


দেশকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বা গণতন্ত্রের জননী বলে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা হলেও মোদী জমানায় প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র বিপন্ন। পদে পদে গণতন্ত্রে টুঁটি টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযান চলছে। সরকারকে প্রশ্ন করার, সরকারের কাজে সমালোচনা বা বিরোধিতা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ আমলেও কর্মীরা লড়াই করেছেন নানা দাবিতে লড়াই করে অধিকার অর্জন করেছেন। আজ মোদী মার্কা গণতন্ত্রে সেই অধিকার কেড়ে নিয়ে কর্মীদের ক্রীতদাসে পরিণত করার ব্যবস্থা হচ্ছে। নীরবে সরকারের হুকুম তামিল করাই কর্মীদের একমাত্র কাজ। হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করা চলছে না। করলেই হিন্দু আবেগে আঘাতের অজুহাতে পুলিশি হয়রানি, অতপর গ্রেপ্তার। যদি অভিযুক্ত সংখ্যালঘু হয় তাহলে দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী তক্‌মা দুলিয়ে অনির্দিষ্টকালের জেল। সর্বজন সত্য ও বাস্তবকে তুলে মানুষের জীবন যন্ত্রণার সামাজিক চিত্র সিনেমায় তুলে আনলেও রক্ষে নেই। বিরুদ্ধে নেমে পড়বে লক্ষ লক্ষ ট্রোল বাহিনী। সততার সঙ্গে সাংবাদিকতার অধিকার নেই মোদীর ভারতে। একের পর এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে অকথ্য নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে পরিযায়ীদের যন্ত্রণা নিয়ে ছবি করে পরিচালক পড়েছেন মোদীর কোপে।


ইদানিং নতুন এক ন্যারেশনকে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা চলছে। সরকার, শাসক দল ও দেশকে এক ও অভিন্ন দেখানো হচ্ছে। ফলে সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা করলেই তাকে দেশদ্রোহিতা বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এমনকি আরএসএস-বিজেপি’র নীতি ও অবস্থানের বিরুদ্ধে কথা বললেও দেশবিরোধী বলে হল্লা শুরু করা হচ্ছে। বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে ভারতের পরিচয় হিন্দুত্ববাদে। আর বিজেপি-আরএসএস সেই ভারতের একমাত্র জিম্মাদার।
 

Comments :0

Login to leave a comment