শমীক লাহিড়ী
রাজশেখর বসু’র এক অনবদ্য গল্প ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’। নিশ্চয়ই মনে আছে সেই কুখ্যাত চরিত্র গন্ডেরিরাম বাটপারিয়াকে। গন্ডেরিরাম শুধু প্রতারকই নয়, অন্যদের তুলনায় সে অনেক বেশি ঝুঁকিও নিতে পারে। এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল এইভাবেই– “দুঃসাহসিক ব্যবসায়ী গন্ডেরিরাম আসরে অবতীর্ণ হওয়া মাত্র নিমেষ মধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা জমকালো হইয়া উঠিল, আকাশে যেন তড়িৎ প্রবাহ খেলিয়া গেল এবং দুই-চার হাজার হইতে আমরা এক লাফে দুই-চার লাখের জগতে উন্নীত হইলাম।” এ গল্প ১৯২২ সালে লেখা।
ধর্ম ব্যবসায়ীদের এমন লোভী চকচকে চোখ আর উল্লাসের বর্ণনা আর কোন গল্পে আছে জানা নেই। আজ এই গল্প লিখলে ওনাকে নির্ঘাত ইউএপিএ ধারায় ‘যাবজ্জীবন ফাঁসি’ই দিত। বাটপারিয়ারা কিন্তু এখনও বহাল তবিয়তেই আছে, শুধু নামগুলো আলাদা।
কে এই গৌতম আদানি
ঠিক যেভাবে শুধু শেয়ারের ভেলকিবাজিতে গন্ডেরিরাম বাটপারিয়া বিপুল অর্থ কামিয়ে সরে পড়েছিল, তেমনই কাজে সিদ্ধহস্ত আদানি ভাইয়েরা। আর আদানি ভাইদের রকেট গতিতে উত্থান মোদী ভাইয়ের দাক্ষিণ্যেই। এই দুই ‘ভাই’ (নাকি ভাইরাস!) এখন দেশের প্রায় সব সম্পদের বিক্রেতা ও ক্রেতা।
১৯৮১ সালে ১৯ বছর বয়সে, প্লাস্টিক ব্যবসায় ভাইকে সাহায্য করতে মুম্বাই থেকে গুজরাটে ফিরে আসেন গৌতম আদানি। ১৯৮৮ সালে একটি পণ্য কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করেন, যার বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল মাত্র ২.২ কোটি টাকা। ২০০১ সালে নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময়েও তার ছিল শুধুই পণ্য কেনাবেচার ব্যবসা, যার বার্ষিক লেনদেন ছিল ৩৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ তখনও তিনি ছিলেন কেবলমাত্র একজন একটু বড় মাপের ব্যবসায়ী বা ট্রেডার। মোদী ভাইয়ের কল্যাণে এখন ২০২৪ সালে তাঁর ও তাঁর পরিবারের মোট সম্পদের পরিমাণ ১১ লক্ষ ৬১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। কী নেই তাঁর ঝুলিতে! দেশের ২৪টি জায়গায় ১৫.২৫ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুত রাখার গুদাম থেকে শুরু করে দেশের ৯টি কোল ব্লকের ১৬৮.৫৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে কয়লা খনি, ৭টি বৃহৎ বিমান বন্দর, ভারতে ১৩টি এবং বিদেশে ২টি বৃহৎ জাহাজ বন্দর, ১৫,২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির কোম্পানি সহ ‘আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট’ অর্থাৎ সব ধরনের ব্যবসা এদের হাতে।
এই বিস্ময়কর রকেটগতির উত্থান নজর কাড়ে বিশ্বের সবারই। ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি সামনে আসে এক বেসরকারি মার্কিনী সংস্থা গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টে। এই সংস্থার একশোরও বেশি পাতার রিপোর্ট, তার উত্তরে আদানি ভাইদের ৪ শতাধিক পাতার ‘ধোকলা’ উত্তর, আবার তার উত্তরে হিন্ডেনবার্গের প্রেস বিবৃতি, যাতে বলা হয়েছে আদানি ভাইদের বিরুদ্ধে ওঠা ৮৮টি প্রশ্নের ৬৬টি প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেনি আদানি ভাইয়েরা— এইসব পড়ে যে কারোরই মাথা ঘুরে যাওয়া স্বাভাবিক। তাই ভালো করে বোঝার জন্য পরশুরামের অমর সৃষ্টি ওই গল্পটা আর একবার পড়া খুবই জরুরি। ঠিক ১০১ বছর আগে রাজশেখর বসুর মতো এক রসায়নবিদ কীভাবে আজকের গন্ডেরিরাম হর্ষদ মেহেতা, আদানি ভাইদের চিনেছিলেন, এটা বোঝা খুবই দুষ্কর।
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তাদের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি। এই রিপোর্ট তৈরি করার জন্য তারা ২ বছর ধরে অনুসন্ধান চালায়। ১০০ পাতারও বেশি এই অনুসন্ধান রিপোর্টে তারা কতগুলি গুরুতর সাংঘাতিক প্রতারণার অভিযোগ তোলে আদানি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর বিরুদ্ধে। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের তদন্তে উঠে আসা মূল অভিযোগগুলি নিম্নরুপ -
১. ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১১.৬১ লক্ষ কোটি টাকা) সম্পদের মালিক গৌতম আদানি সাংঘাতিকভাবে শেয়ার বাজারে দুর্নীতি করেছেন। প্রতারণা, অন্যায় ও বেআইনি কৌশল গ্রহণ সহ নানাবিধ অপরাধের মাধ্যমে বিগত ১ দশক ধরে এই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে।
২. এই ১২০ (মতান্তরে ১৪০) বিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে বিগত ২০১৯-২২, এই ৩ বছরে। আর এই সম্পদ বৃদ্ধি মূলত ঘটেছে আদানির বিভিন্ন কোম্পানিগুলির অস্বাভাবিক হারে শেয়ারদর বা মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে। এদের ৭টি স্টক এক্সচেঞ্জভুক্ত মূল কোম্পানির শেয়ারগুলির বাৎসরিক বৃদ্ধির গড় ছিল ৮১৯%।
৩. আদানি গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিগুলির শীর্ষে বসে থাকা প্রায় সবাই গৌতম আদানির পরিবারেরই সদস্য। অর্থাৎ এককথায় এটি মূলত পারিবারিক ব্যবসা।
৪. এর আগে ৪টি সরকারি তদন্তে এদের জালিয়াতির কথা প্রকাশ্যে এসেছিল। মোট জালিয়াতির পরিমাণ ছিল ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা)।
৫. বিভিন্ন ছদ্ম ও বেনামী কোম্পানি (Shell Company) তৈরি ক'রে মরিশাস, সংযুক্ত আমিরশাহী ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের নানা দেশের মাধ্যমে বেআইনি লেনদেন এবং ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিজেদের শেয়ার মূল্যকে দেখানোর কাজ করেছে আদানি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।
৬. গৌতম আদানির ভাই রাজেশ আদানি ২০০৪-২০০৫ সালে হীরা ব্যবসার ক্ষেত্রে এই ধরনের ছদ্ম ও বেনামী কোম্পানির মাধ্যমে লেনদেন করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। Directorate of Revenue Intelligence তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং রাজেশ আদানি ২বার গ্রেপ্তারও হয় কর ফাঁকি ও প্রতারণার অভিযোগে। একইভাবে গৌতম আদানির শ্যালক সমীর ভোরাও অভিযুক্ত হয় ঐ একই মামলায়।
৭. গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানি একটি অত্যন্ত রহস্যময় চরিত্র। তাঁর মূল কাজ বিদেশে বিভিন্ন ছদ্ম-বেনামী কোম্পানির মাধ্যমে আদানি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মূল কোম্পানিগুলিতে বেআইনি টাকার লেনদেনের মাধ্যমে নিজেদের শেয়ার মূল্য ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাড়িয়ে দেখানো। শুধুমাত্র মরিশাসেই বিনোদ আদানি এবং এর ঘনিষ্ঠদের এরকম ৩৮টি ছদ্ম-বেনামী কোম্পানির হদিশ পাওয়া গেছে। এছাড়াও সাইপ্রাস, সংযুক্ত আমিরশাহী, সিঙ্গাপুর ও বিভিন্ন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এইরকম আরও অনেক ছদ্ম-বেনামী কোম্পানি চালায় এরা। এই ছদ্ম-বেনামী কোম্পানিগুলির কর্মচারী, ঠিকানা ইত্যাদি অদ্ভুতভাবে একইরকম অথবা অনুল্লেখিত। উদাহারণ স্বরূপ এই কোম্পানিগুলির ১৩টা ওয়েবসাইট সন্দেহজনকভাবে একই দিনে তৈরি করা হয়েছে এবং কোম্পানিগুলির ঘোষিত উদ্দেশ্য অত্যন্ত ভাসাভাসা অথবা অনুপস্থিত।
৮. 'হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ' ভারতের তথ্য সংক্রান্ত আইনে সেবি’র কাছ থেকে জানতে পারে যে, এই বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ সম্পর্কে তদন্ত শুরু হয়েছে। যদিও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম এই নিয়ে বিগত দেড় বছর ধরে নানা প্রশ্ন তোলা সত্ত্বেও সেবি নিজে থেকে কোনও তদন্ত শুরু করেনি।
৯. 'ইলারা ক্যাপিটাল' নামক একটি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারী কোম্পানি প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে আদানি'র নানা কোম্পানিতে। এদের কার্যকলাপ অত্যন্ত সন্দেহজনক। (অভিযোগ, এই কোম্পানির মাধ্যমে টাকা আনার বিনিময়ে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পুত্র এই সস্থার উচ্চ পদে আসীন হন। বরিস জনসনও এই কারণেই ভারতে এসেই আদানি’র সদর দপ্তরে সভা করতে আমেদাবাদে গিয়েছিলেন।)
১০. বর্তমানে জেলবন্দি শেয়ার বাজারের কুখ্যাত জালিয়াত ও প্রতারক কেতন পারেখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ছদ্ম-বেনামী কোম্পানিগুলির গোপন ই-মেল পত্রালাপ ফাঁস হয়ে গিয়েছে। ধর্মেশ দোশী নামে এক রহস্যময় ব্যক্তির সাথে 'ইলারা ক্যাপিটাল’কোম্পানির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কথা এই ই-মেলগুলি থেকে প্রমাণিত হয়। ধর্মেশ দোশী বর্তমানে গ্রেপ্তার এড়াতে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে।
১১. 'মন্টেরোসা' নামক আর একটি বিনিয়োগকারী সংস্থা, আদানি গ্রুপের শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত কোম্পানিগুলির ৩৬ হাজার কোটি টাকার শেয়ার নিজেদের দখলে রেখেছে। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইও এমন ৩টি কোম্পানির ডাইরেক্টর, যেগুলির মালিক বর্তমানে জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত একজন হীরা ব্যবসায়ী। ইনি বর্তমানে ব্যাঙ্কের ৮ হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। (গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানির মেয়ের সাথে আবার এই পলাতক জালিয়াত হীরা ব্যবসায়ীর ছেলের বিয়ে হয়েছে।)
১২. 'নিউ লিয়াইনা' নামক একটি সাইপ্রাসস্থিত ছদ্ম-বেনামী কোম্পানি 'আদানি গ্রিন এনার্জি কোম্পানি'তে ৪২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে ২০২১ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। 'নিউ লিয়াইনা' মূলত আদানির শেয়ার মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর জন্যই তৈরি করা এবং এটা পরিচালনা করে 'এমিকর্প' নামে একটি পরিষেবা দেওয়ার কোম্পানি। 'এমিকর্প' অন্তত ৭টি আদানি গ্রুপের কোম্পানি এবং ১৭টি বিদেশি ছদ্ম-বেনামী কোম্পানির স্রষ্টা, যেগুলির সাথে মূলত বিনোদ আদানি যুক্ত। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, 'এমিকর্প' আর্ন্তজাতিক প্রতারণায় অভিযুক্ত এবং মালেশিয়ার করদাতাদের ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত।)
১৩. ২০০৭ সালে 'সেবি' তাদের তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল - আদানি গ্রুপের প্রোমোটাররা কুখ্যাত জালিয়াত কেতন পারেখকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে, এটা প্রমাণিত। এই রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ১৪টি আদানি নিয়ন্ত্রিত সংস্থা, কেতন পারেখ নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিতে শেয়ার লেনদেনের কাজে সরাসরি যুক্ত ছিল।
১৪. আদানির বিভিন্ন সংস্থা নানা রকম গোপন বেআইনি লেনদেন চালিয়েছে নানা ছদ্ম-বেনামী কোম্পানিগুলির সাথে। যেমন বিনোদ আদানি নিয়ন্ত্রিত মরিশাসস্থিত একটি কোম্পানির সাথে ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকার লেনদেন করেছে, কিন্তু তার কোনও উল্লেখ কোথাও নেই। এছাড়াও আরও ৯৮৪ কোটি টাকার একটি লেনদেনেরও কোনও উল্লেখ নেই। একইভাবে বিনোদ নিয়ন্ত্রিত সংযুক্ত আমীরশাহী’র একটি সংস্থার মাধ্যমে আদানির বিদ্যুৎ কোম্পানিতে ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগেরও কোনও উল্লেখ নেই।
১৫. আদানির বিভিন্ন সংস্থার অডিট করে 'শাহ ধান্ধারিয়া' নামক একটি অডিট কোম্পানি। এই কোম্পানির বর্তমানে কোনও ওয়েবসাইট নেই। পুরানো ওয়েবসাইট আর্কাইভ থেকে দেখা যাচ্ছে এই কোম্পানির ৪ জন অংশীদার ও মাত্র ১১ জন কর্মচারী ছিল। মাত্র ৩২ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া নিয়ে এর মূল অফিস ছিল। অথচ এদের শেয়ার মূল্য নাকি ৬৪ কোটি টাকা। মাত্র ১১ জন কর্মচারী নিয়ে ১৫৬টা আদানি নিয়ন্ত্রিত সংস্থার অডিট করা কীভাবে সম্ভব? আদানি টোটাল গ্যাস কোম্পানির বাৎসরিক অডিট রিপোর্টে যে অডিটরের স্বাক্ষর আছে, তাঁর বয়স মাত্র ২৩-২৪ বছর।
১৬. হিন্ডেনবার্গ তদন্ত প্রমাণ করে যে আদানিগ্রুপ একটি বিশাল জালিয়াতি এবং প্রতারণা চালাতে পেরেছে বছরের পর বছর ধরে মূলত বিনিয়োগকারী, সাংবাদিক, নাগরিক এমনকি রাজনীতিবীদদেরও অনেকেই এদের দাপটে ভীত বলেই।
এছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উঠে এসেছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তদন্তে, যার সবটা উল্লেখ করা সম্ভব নয় একটি প্রবন্ধে।
রকেট গতিতে উত্থান
২০১৪ সালে আদানি এন্টারপ্রাইজের যে শেয়ারের মূল্য ছিল মাত্র ৪১ টাকা, ২০২৩ এ সেই শেয়ারের মূল্য বেড়ে হয়েছিল ৩৮০০ টাকা। কোভিডের আগে ২০১৯ সালেও এই শেয়ারের মূল্য ছিল মাত্র ১৬০ টাকা। অবশ্য হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট প্রকাশের পরের দিনই আবার এর দাম কমে দাঁড়িয়েছিল ২,১১৮ টাকায়।
উত্থান কিভাবে?
২০০২ সালে গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে অভিযুক্ত তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাশ থেকে সরে যায় বহু দেশি-বিদেশি শিল্প গোষ্ঠী। এই সময়েই আদানির মঞ্চে প্রবেশ। নরেন্দ্র মোদীর বৃত্তে অনুপ্রবেশ ক'রে সরকারি দাক্ষিণ্যে অনেকগুলি সরকারি প্রকল্প এবং জমি হস্তগত করেন গৌতম আদানি। সখ্যতা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে সময়ের সাথে সাথে।
২০১২ সালে 'ভাইব্রেন্ট গুজরাট' শীর্ষক শিল্প সম্মেলনে প্রথম নরেন্দ্র মোদীকে জাতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেন গৌতম আদানি সহ আরও কয়েকজন। এরই ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জয়লাভ করলে নরেন্দ্র মোদী হন দেশের প্রধানমন্ত্রী। গুজরাটের বৃত্ত ছাড়িয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে একই সাথে প্রবেশ ঘটে গৌতম আদানিরও।
অতি দক্ষিণপন্থার উত্থান এবং বাছাই করা কর্পোরেটদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি পরস্পরের হাত ধরেই চলে, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
কর্পোরেট পুঁজি বা লগ্নিপুঁজির বিশেষ সমর্থন ছাড়া অতি দক্ষিণপন্থা বা ফ্যাসিবাদের উত্থান কখনই হয় না। প্রখ্যাত পোলিশ অর্থনীতিবীদ মিশ্যঁল কালেকি, ফরাসি অর্থনীতিবীদ ড্যানিয়েল গুয়েরিন সহ বহু অর্থনীতিবীদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানির হিটলারের উত্থানের পেছনে ‘বেয়ার কোম্পানি’ সহ আরও কয়েকটি কর্পোরেট, ইতালিতে মুসোলিনীর উত্থানে ‘ফিয়াট’ সহ কয়েকটি কর্পোরেট, জাপানে তোজোর উত্থানে নিও জাইবাৎসু বা নতুন শিল্প গোষ্ঠী যেমন ‘নিশান’ ইত্যাদি কর্পোরেটগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল – এগুলো তথ্য সহকারে দেখিয়েছিলেন।
দেবে আর নেবে
একইভাবে আমাদের দেশেও নরেন্দ্র মোদীর উত্থানে আদানি সহ হাতে গোনা কয়েকটি কর্পোরেট বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে, যা আজ প্রমাণিত। দিল্লির একটি অসরকারি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছিল। অর্থাৎ প্রতিটি লোকসভা আসনে গড়ে ৪৯.৮২ কোটি টাকা খরচ করেছিল বিজেপি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে আনুমানিক ১ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয়েছে যা ২০১৯ সালে ছিল আনুমানিক ৫৫-৬০ হাজার কোটি টাকা। অনুমান এই ১ লক্ষ কোটি টাকার ৫৫% অর্থ একাই বিজেপি খরচ করেছে। অর্থাৎ কেন্দ্র পিছু ১০১ কোটি টাকারও বেশি খরচ করেছে তারা। কারা দিল এই অর্থ?
যে অর্থ ঢেলেছে এই কর্পোরেট কোম্পানিগুলি বিজেপি’র জন্য, তার কয়েকগুণ অর্থ এরা লুট করে নিচ্ছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। আজকের যুগে লুটেরা পুঁজিবাদ (Crony Capitalism) ও শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে এক গভীর অনৈতিক অশুভ আঁতাত গড়ে উঠেছে। এই অশুভ আঁতাতের ফলেই বিপুল লুট চালানো সম্ভব হচ্ছে বাছাই করা কয়েকটি কর্পোরেট কোম্পানির পক্ষে।
শুধু এদেশেই নয়, অতি দক্ষিণপন্থী ইজরায়েলের নেতানেয়াহু সরকারের আনুকুল্যে সেই দেশের পোর্ট, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি, আর্টিফিসায়াল ইনটেলিজেন্স ল্যাব সহ নানা জায়গায় বিনিয়োগ ও ব্যবসার রাস্তা তৈরি করেছে আদানি গ্রুপ। অবশ্যই এক্ষত্রেও মোদী ভাইয়ের সহযোগিতা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যুইন্সল্যান্ডে কয়লা খনি, পোর্ট, রেল ইত্যাদি বিনিয়োগের রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য নরেন্দ্র মোদী নিজেই সে দেশে ছুটে গিয়েছিলেন শুধু তাই নয়, প্রাথমিক বিনিয়োগের অর্থ জোগাড় করার জন্য ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ককে মাঝে রেখে বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে নিজে ডেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এও তো সবাই জানে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায় গণবিক্ষোভে এই প্রকল্প বাতিল করে সেই দেশের সরকার।
দেশের একটার পর একটা সরকারি সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে আদানি শিল্প গোষ্ঠীর হাতে। এই সম্পদ কেনার জন্য আবার সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা নিগম, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া সহ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
জীবন বিমা নিগম আদানি গ্রুফ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ৩০,১২৭ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছিল যার বর্ধিত মূল্য দেখানো হয়েছিল ৫৬,১৪২ কোটি টাকা। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক একইভাবে ৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার তৎকালীন চেয়ারম্যান দীনেশ খাড়া ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন বিনিয়োগের পরিমাণ ২৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও জম্মু-কাশ্মীর ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অব বরোদাও বিপুল টাকা ঢেলেছে আদানির নানা ব্যবসায়ে।
কিন্তু হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর যে অসম্ভব গতিতে আদানির কোম্পানিগুলির শেয়ার মূল্য কমছিল তাতে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি যে ক্ষতির মুখে পড়ছে, তার কোনও উল্লেখ সরকার করেনি। অভিযোগ, তখন মোদী সরকার নানা কর্পোরেট সংস্থাকে নাকি প্রভাবিত করছিল, যাতে ডুবন্ত শেয়ার মূল্যকে ভাসিয়ে রাখার জন্য আদানি’র কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনে তারা।
আড়াল করো অপরাধ
এর আগে আদানিদের হীরে ব্যবসায় কর ও শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে চলা তদন্ত হঠাৎই বন্ধ হয়েছিল কার নির্দেশে? বিদ্যুৎ সরঞ্জাম নিয়ে চলা তদন্তই বা ধামাচাপ পড়ল কিভাবে? কর্নাটকে লৌহ আকরিক আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আদানিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলা তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল কার নির্দেশে? এর প্রতিবাদে বিচারপতি হেগড়ে পদত্যাগও করেছিলেন। সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা’কে জেলে পাঠানো হয়েছিল, আদানিদের দুর্নীতি প্রকাশ্যে আনার জন্য। এরকম বহু ঘটনা দেখে মনে হতেই পারে, আদানিদের অপরাধ আড়াল করাই যেন বিজেপি সরকারের মূল কাজ।
লুট হচ্ছে মানুষের টাকা
সরকারি ব্যাঙ্ক বা বিমা কোম্পানিতে অর্থ গচ্ছিত রাখেন সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের গচ্ছিত এই টাকা অবাধে লুট হচ্ছে। আদানি গ্রুপ অব কোম্পানির শেয়ার মূল্য পতনের ফলে আসলে সাধারণ মানুষের সঞ্চিত টাকাই লুট হয়ে যায়। ঠিক যেমন সারদা-রোজভ্যালি সহ অনেকগুলি পঞ্জি কোম্পানিতে মানুষের গচ্ছিত টাকা লুট হয়ে গিয়েছিল তৃণমূল সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তায়, তেমনভাবেই সরকারি ব্যাঙ্ক-বিমায় গচ্ছিত সাধারণ মানুষের অর্থ লুট হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। ঐ পঞ্জি কোম্পানিগুলি বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে তৃণমূলের সরকার গঠনের জন্য যেমন বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিল, তেমনই ক্রোনি কর্পোরেট কোম্পানিগুলিও নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করা ও তাঁর সরকার রক্ষার জন্যও অর্থ ব্যয় করে চলেছে।
ভাই-বহেন এক হ্যায়
আদানির এই সর্বগ্রাসী লুটের বিরুদ্ধে খুব স্বাভাবিকভাবেই নীরব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। সংসদে আদানিদের লুটের বিরুদ্ধে বিরোধীদের বিক্ষোভ বা বিরোধী দলের সভায় অনুপস্থিত তৃণমূল সাংসদরা, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই। এই রাজ্যে দেউচা পাচামীর ১০ হাজার একর জমি, তাজপুর পোর্ট সহ অনেক প্রকল্প আদানিদের হাতে তুলে দেওয়ার কারিগর মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। এই জন্যই বিজেপি ৫,২৭০ কোটি টাকা নির্বাচনী বন্ড তহবিলে পেয়েছিল, আর তার পরেই স্থান তৃণমূলের। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৫২৮.১৪ কোটি টাকা জমা হয়েছিল তৃণমূলের তহবিলে ২০২২ সালে, যা আগের বছর যা ছিল মাত্র ৪২ কোটি টাকা। কারা দিল?
লুটেরাদের প্রতিনিধি বিজেপি- তৃণমূল
নরেন্দ্র মোদী-মমতা বন্দোপাধ্যায় দেশ-রাজ্যের সাধারণ মানুষকে লুট করার অবাধ সুযোগ করে দিচ্ছেন আজকের যুগের গন্ডেরিরাম বাটপারিয়াদের আর তার বিনিময়ে এদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া আর ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অর্থ জোগাচ্ছে এ যুগের জালিয়াতরা। এই জালিয়াতদের হাতেই আছে দেশের বেশিরভাগ টেলিভিশন-সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণ। তাই বাটপারিয়াদের কাহিনীও তেমনভাবে প্রকাশিত হয় না, আর তার লুটের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদও প্রতিফলিত হয় না বাজারী সংবাদমাধ্যমে।
Comments :0