হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান মেনে নতুন সংসদভবনে যখন ‘সম্রাট’ মোদীর অভিষেক হচ্ছে, দিল্লির রাজপথে অমিত শাহর পুলিশ তখন বীর বিক্রমে মহিলা কুস্তিগিরদের বিরুদ্ধে পৈশাচিক বর্বরতার প্রদর্শন করছে। বিশ্বমঞ্চে দেশের মুখ উজ্জ্বল করা সোনার মেয়েদের বেধড়ক লাথি-ঘুষি ও লাঠিপেটা করে টেনে হিঁচড়ে তুলেছে পুলিশ ভ্যানে।
মোদীর অভিষেক পর্ব মসৃণ করতে শাহ এমন অতি সক্রিয়তা দেখাবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। গত জানুয়ারি মাস থেকেই দফায় দফায় প্রতিবাদ-ধরনা কর্মসূচি পালন করছেন মহিলা কুস্তিগিররা। গত এক মাস ধরে দিল্লির যন্তরমন্তরে টানা অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। আরজি একটাই। তাদের উপর সংগঠিত যৌন নির্যাতনের ন্যায় বিচার চাই। সেই আরজি পূরণ তো দূরের কথা প্রধানমন্ত্রী পাত্তাও দেননি। মুখ থেকে বের হয়নি একটি শব্দও।
নিছক উপেক্ষা বা অবহেলা নয়, প্রধানমন্ত্রীর ভাবসাব দেখে এমনটাই মনে হতে পারে এসব ফালতু বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো বা সময় নষ্ট করার মতো সময় তার নেই, ইচ্ছাও নেই। তাছাড়া যৌন নির্যাতনের শিকার কুস্তিগিররা কিনা তাদের সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এমন ঔদ্ধত্য মেনে নেওয়া যায় না। অমিত শাহ তাই তাঁর মহান কর্তব্য পালন করেছেন দেশে মাথা উঁচু করা মেয়েদের সঙ্গে রাস্তার কুকুরের মতো আচরণ করে।
শাহ’র পুলিশ তাদের মেরে ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, গুচ্ছ গুচ্ছ ধারায় অভিযোগও দায়ের করেছে। তারা দাঙ্গা বাধাতে চেয়েছে বলেও কেস দেওয়া হয়েছে।
কী অপরাধ এই মেয়েদের? তাদের উপর যৌন নির্যাতনের বিচার চাওয়াটাই অপরাধ?
কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি মোদী-শাহ-যোগীর প্রিয়পাত্র ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের কদর্য যৌন লালসার শিকার মহিলা কুস্তিগিররা। তাদের একা পেলে অথবা আলাদা করে ডেকে নিয়ে যৌন হেনস্তা করা হতো বলে অভিযোগ ৫ বারের সাংসদ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে। যৌন হেনস্তার শিকার অভিযোগকারীদের রাস্তায় ফেলে অমিত শাহ’র পুলিশ যখন পেটাচ্ছে তখন যৌন নির্যাতনের অভিযুক্ত সাংসদ নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাসি মুখে ছবি তুলছেন।
যে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাতদিন পরেও পুলিশ এফআইআর করেনি সেই পুলিশের সাত ঘণ্টাও সময় লাগেনি অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে। আসলে মোদী রাজত্বে নতুন ভারতে শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলার ছাড়পত্র নেই। একজন বিজেপি সাংসদ, হোন না তিনি যৌন নির্যাতনকারী, কখনোই অভিযুক্ত হতে পারে না। শাসকের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা আজকের ভারতে নিষিদ্ধ।
অথচ যে মেয়েরা আগে শাসক দলের সাংসদ দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে এখন তার বিচার চাইতে রাস্তায় নেমে পুলিশের মার খেয়েছে সেই মেয়েদের নিয়ে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীর আদিখ্যেতার অন্ত ছিল না। এই মেয়েদেরই মোদী দেশের গর্ব বলেছিলেন। পদক জয় করে দেশে ফেরার পর সশরীরে তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কত না কথা বলেছিলেন। তাদের স্বাক্ষর করা জার্সি নিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী এমন গদগদ মহানুভবতা দেখে কুস্তিগিররা দারুণ খুশি হয়েছিলেন। ভাবলেন সত্যিই দেশ তাদের যোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বহু প্রচারিত ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ ঘোষণার দূত হিসাবে নিয়োগ করা হয় এই মহিলা কুস্তিগিরদের। আজ সেই মেয়েরা সেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে অবাঞ্ছিত। তাদের উপর যৌন হেনস্তার কথা জেনেও তিনি নীরব। যদি বিরোধী দলের কোনও সাংসদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠত তাহলে মোদী-শাহ-সহ গোটা দল দেশজুড়ে ঝড় তুলে দিত।
অপরাধ যে মাত্রার হোক বা যার বিরুদ্ধেই হোক শাসকদলের নেতাদের বিরুদ্ধে তা উচ্চারণ করা যাবে না। সম্রাট মোদীর শাসনে শাসকের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা যাবে না। মোদীর গণতন্ত্রে শাসক দল রাজার পক্ষ। তারা সব কিছুর উর্ধ্বে। তাদের অবাধ অধিকার। সাত খুন মাফ।
এই ব্যবস্থায় কোনও নাগরিক স্বাধীনতা নেই। নেই গণতান্ত্রিক অধিকার। বিশেষ করে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ মানা যাবে না। অতি ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী এই ব্যক্তিকে সরালে উত্তর প্রদেশের ভোটে বিরূপ ফল ফলার আশঙ্কা। বিশেষ করে ঠাকুররা বিজেপি-কে ত্যাগ করতে পারে। আগামী লোকসভা ভোটের আগে জাতপাতের অঙ্ককষে মোদী-শাহ’র ব্রিজভূষণের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে রাজি নন।
Comments :0