আরও একটি আইসিসি টুর্নামেন্টের নকআউট ম্যাচ। আবারও হার। চিত্রটা বদলানো গেল না! এবারের টি-২০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল তথা নকআউটে ভারতের কঙ্কালসার চেহারাটাই যেন বেরিয়ে আসল। মোদ্দা কথা, নকআউট ম্যাচের স্নায়ুর চাপ সামলাতে পারছেন না রোহিতরা। এর জন্যই কুড়ি-বিশের বিশ্বকাপের আগে দলের সঙ্গে ক্রীড়া মনস্তত্ত্ববিদ প্যাডি আপটনকে নিয়োগ করা হয়েছিল, কিন্তু লাভ হলো না কিছুই!
বিগত আট বছরে আইসিসি প্রতিযোগিতাগুলিতে এতগুলি সেমিফাইনাল, ফাইনালগুলিতে হেরে ভারতের ঘাড়ে কার্যত ‘চোকার্স’ তকমা লেগেই গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত টি-২০ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে ভারত দশ উইকেটে দুরমুশ হওয়ার পর সেই পালে নতুন হাওয়া লাগল। ২০১৪ থেকে ২০২২ এই আট বছরে সাতটি নকআউট ম্যাচে হার। কোথায় সমস্যা? কেনই প্রতিবার হারতে হচ্ছে বড় ম্যাচগুলিতে? সমাধানের রাস্তা খুঁজে বের করতে পারছে না বিসিসিআই? কোচ বদলেছে, অধিনায়ক পাল্টেছে। তবুও তরী ডুবছে সেই তীরে এসেই!
কয়েক বছর পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ভরাডুবি হয়েছিল। সেবার বাংলাদেশের কাছে হেরে শেষ আটে উঠতে পারেননি ইংল্যান্ড। সেদিনই ইংল্যান্ড বোর্ডের টনক নড়েছিল। তাঁরা সাদা বলের ক্রিকেটের জন্য দলকে ঢেলে সাজিয়েছিল। স্কোয়াডে সমস্ত ভয়ডরহীন ক্রিকেটারদের আমদানি করেছিল। যারা শেষ ছ’বছর ধরে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে সমীহ আদায় করে নিয়েছিল ক্রিকেট সার্কিটের। ঠিক যে পরিকল্পনায় বৃহস্পতিবার ভারতীয় দলকে পরাজিত করল ইংল্যান্ড। সেমিফাইনালের আগেই বেন স্টোকস হুঙ্কার দিয়েছিলেন, তাঁর দল আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলবে পরিবেশ-পরিস্থিতি যাই হোক। ১৬৯ রান তাড়া করতে নেমে জস বাটলার ও অ্যালেক্স হেলস ভারতীয় বোলিং লাইন আপকে পাড়ার স্তরে নামিয়ে আনলেন।
এককথায়, এদিন অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার ধ্বংসলীলা চালিয়েছেন। হেলসের অবদান ৪৭ বলে ৮৬। স্ট্রাইক রেট ১৮২.৯৮। বাটলার করেছেন ৪৯ বলে ৮০। তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৬৩.২৭। তাঁরা এমন ব্যাটসম্যানশিপের জন্য বন্দনা পাচ্ছেন রীতিমতো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টি-২০ ক্রিকেটে ব্যাটারদের(বিশেষত টপ অর্ডার ব্যাটারদের) অ্যাপ্রোচ হওয়া উচিত এমনই। অর্থাৎ প্রথম থেকেই এমন মারতে শুরু করো, যাতে বোলাররা ছন্দ খুঁজে না পায়। পাওয়ার প্লে’কে সঠিকভাবে ব্যবহার করা। ইংল্যান্ড পাওয়ার প্লে’তেই ভারতের কাছ থেকে খেলা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। এটা ভারতীয় দলের কাছে বড় শিক্ষা। সাদা বলের ক্রিকেটে ভালো কিছু করতে হলে আগে ভারতকে আক্রমণত্মক মনোভাব নিতে হবে। টপ অর্ডারে এমন ব্যাটারদের নিয়ে আসতে হবে। যারা প্রথম বল থেকে মারতে জানেন। যাদের ব্যাটিং স্ট্রাইক রেট বেশি । ভারতীয় দলের টপ অর্ডারের তিন ব্যাটার রোহিত শর্মা, কেএল রাহুল ও বিরাট কোহলি। কারোর স্ট্রাইক রেট একশো চল্লিশের উপর নয়!
গোটা বিশ্বকাপে ভারতীয় ওপেনিং জুটি দাঁড়াতেই পারেননি। সেমিফাইনালেও অন্যথা হয়নি। আর কবে বড় ম্যাচে রান করবেন লোকেশ রাহুল(৫)? এখনও তিনি সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার! অধিনায়ক রোহিতের(২৮ বলে ২৭) ব্যর্থতা অব্যাহত। চাপটা এসে পড়েছিল মিডল অর্ডারের উপর। প্রয়োজনের সময় সূর্য রান পাননি। পরপর উইকেট পড়ে যাওয়ায় একপ্রান্ত ধরে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন বিরাট (৫০)। তবুও অ্যাডিলেডের মতো উইকেটে (বল যতই থমকে আসুক ব্যাটে) শুরু থেকেই ভারতীয় দলের মনোভাব ছিল রক্ষণাত্মক। কেমন যেন খোলসে ঢুকে ছিল? চলতি বছরের ইংল্যান্ড বিরুদ্ধে টি-২০ সিরিজে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলার কথা বলেছিলেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। কয়েকটি সিরিজে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে সফলও হয়েছিল ভারত। প্রাক্তন কোচ রবি শাস্ত্রী অবধি সমর্থন করেছিলেন। দ্বিপাক্ষিক সিরিজে সফল হওয়ার পর বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে অ্যাটাকিং ব্র্যান্ডের ক্রিকেট কেন খেলল না ভারত? প্রশ্ন উঠছে টিম থিঙ্কট্যাঙ্কের পরিকল্পনার দিকেও? সেমিফাইনালে হারের জন্য ক্রিকেট পন্ডিতরা আঙুল তুলছেন ভারতের ‘কনজারভেটিভ’ এবং ‘টিমিড’ ব্যাটিংয়ের দিকে! প্রথম ৩৬ বলে ভারতের সংগ্রহ মাত্র ৩৮। ১৪ ওভারে ভারতের রান ছিল ৯০। এখান থেকে হার্দিকের (৩৩ বলে ৬৩) বেদম প্রহারে শেষ ছ’ওভারে উঠল ৭৮। এত মারার পরও শুরুর ঘাটতি পরে মেটানো যায়নি। ম্যাচের শেষে রাহুল দ্রাবিড় নিজেই বললেন সেকথা। ‘আমরা পনেরো রান কম করেছি।’ পাওয়ার হিটারে ভর্তি ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপের কাছে ভারত লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিল মাত্র ১৬৯। এমনিতেই ডনের মাঠে সন্ধ্যায় ব্যাটিং করা অনেক সহজ হয়ে যায়। ফলত, বাটলার ও হেলসের কাছে গোটা ব্যাপারটাই ছিল কেকের উপর দিয়ে হাঁটার মতো। ভারতীয় বোলিং লাইন আপে একজনও ‘এক্স ফ্যাক্টর’ নেই! যে একটা স্পেলে এসে দু’তিনটি উইকেট নিয়ে ম্যাচের রং বদলে দিতে পারবেন। গ্রুপ পর্যায়ে ভুবি ও অর্শদীপরা পাওয়ার প্লে’তে উইকেট পেয়েছিলেন। সেমিফাইনালে পেলেন না। কেউই পায়নি যদিও, গোটা বোলিংলাইনআপটাই ছিল নির্বিষ। ভুবিদের লাইন লেংথে ঠিকঠাক হচ্ছিল না। বাটলাররা দ্রুত বলের লাইন পড়ে ফেলে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন বলগুলিকে। ভারতীয় ইনিংসএ রিস্ট স্পিনার আদিল রশিদ কৃপণ স্পেল করে কোহলি-রোহিতদের আটকে রাখলেন। টার্ন পাচ্ছিলেন তিনি। ভারতীয় দলে লেগ স্পিনার যজুবেন্দ্র চাহাল থাকতেও তাঁকে খেলানো হলো না। এত ভুলচুক হলে কখনোই বিশ্বকাপের বড় ম্যাচ জেতা যায় না। হারের পর সেই একই যুক্তি। কোচ দ্রাবিড়ের কথায়, ‘সেমিফাইনালে ইংল্যান্ড আমাদের থেকে ভালো ক্রিকেট খেলেছে। আমরা স্রেফ উড়ে গিয়েছে। আমরা হতাশ।’
২০২২ টি-২০ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল হার নির্বাচকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, সময় এসেছে এবার নতুনভাবে ভাবার। দলটাকে নতুন আঙ্গিকে সাজানোর। আগ্রাসী ক্রিকেটার খুঁজে বের করা। যারা প্রথম বল থেকে মারার চেষ্টা করবে। এবং দলের মাইন্ডসেট হবে ভয়ডরহীন...
সংক্ষিপ্ত স্কোর—
ভারত- ২০ ওভারে ১৬৮/৬ (হার্দিক ৬৩, বিরাট ৫০, জর্ডান ৩/৪৩)
ইংল্যান্ড- ১৬ ওভারে ১৭০/০ (হেলস অপরাঃ ৮৬, বাটলার ৮০, অক্ষর ০/৩০)
ইংল্যান্ড দশ উইকেট জয়ী
ম্যাচের সেরা- অ্যালেক্স হেলস
Comments :0