Post Editorial

এলওসিএফ মগজ ধোলাইয়ের নতুন যন্ত্র

উত্তর সম্পাদকীয়​

দীপ্তজিৎ দাস

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সাময়িক ধাক্কা সামলে আবারও উগ্রমূর্তি ধারণ করতে শুরু করেছে মোদী সরকার। আরএসএস’র রাজনৈতিক প্রোজেক্ট হিন্দুত্ব মূল ট্র্যাকে ফিরেই ছুটতে শুরু করেছে দুর্বার গতিতে। কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক মানুষ বিরোধী নীতির বুলডোজার ছুটে যাচ্ছে জনজীবনের উপর দিয়ে। 
সরকারে আসীন হওয়ার পর থেকেই বিজেপি’র আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। তবে ফ্যাসিবাদ তার চরিত্র বদলেছে। নাৎসি জার্মানিতে প্রতিটি ক্লাসঘরে থাকতো হিটলারের ছবি। ক্লাস শুরুর আগে শিক্ষক বলতেন, 'For the Fuherer a triple victory', পড়ুয়ারা উঠে দাঁড়িয়ে বলতো, 'Heil Heil Heil'। নয়া ফ্যাসিবাদ ক্লাসঘরে ছবি না টাঙিয়ে দখল নেয় শিক্ষানীতির, দখল নেয় সিলেবাসের। মগজ দখলের লক্ষ্যে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিণত করতে চায় হীরক রাজার যন্তর মন্তর ঘরে। সেই কায়দাতেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দখল করে সমাজের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চাইছে বিজেপি। সেই আকাঙ্ক্ষাতেই তাদের আস্তিনের নতুন তাস ইউজিসি দ্বারা সদ্য প্রকাশিত লার্নিং আউটকামস বেসড কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক (LOCF)।
এলওসিএফ ড্রাফট এবং তার প্রস্তাবনা

নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির (২০২০) দাওয়াই অনুযায়ী পাঠক্রম (syllabus) হবে বহুবিষয়ক (multidisciplinary), ফলাফলকেন্দ্রিক (result oriented) এবং পূর্ণাঙ্গ (holistic)। পড়তে শুনতে বেশ ভালোই। এই কারণে পাঠক্রম সংক্রান্ত নতুন নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়ে ওঠে আবশ্যক। গত ২০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন ৯টি বিষয়ের পাঠক্রম (curriculum) সংক্রান্ত প্রস্তাবনা পেশ করে। প্রধানত পাঠক্রমে ভারতীয় জ্ঞানচর্চা ব্যবস্থার (Indian Knowledge system) নামে একাধিক প্রাচীন অবৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আরএসএস’র রাজনৈতিক লক্ষ্যকে প্রয়োগ করাই এর প্রধান উদ্দ্যেশ্য। আগামী ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার উপর মতামত চাওয়া হয়েছে দেশের মানুষের কাছ থেকে। ৯টি বিষয় হলো গণিত, রসায়ন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, হোম সায়েন্স, শারীরবিদ্যা, কমার্স, অর্থনীতি, ভূগোল, নৃতত্ত্ব। বিষয় ভিত্তিক বিতর্কিত প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপ -
১) গণিত– আগামী দিনে প্রাচীন ভারতীয় গণিত সিলেবাসে বিশেষ সুযোগ নিয়ে প্রবেশ করতে চলেছে। বৈদিক গণিত, ভারতীয় বীজগণিত, জ্যামিতিক মডেলের ধারণা, মৌলিক সংখ্যার ব্যবহার এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রংগোলি, কোলাম ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যালগোরিদম, মন্দিরের স্থাপত্য কলা, সূর্য চন্দ্রের অবস্থান থেকে প্রাচীন ভারতীয় কালগণনা, প্রাচীন ভারতীয় ক্যালেন্ডার আসতে চলেছে গণিতের সিলেবাসে। ইউজিসি’র সিলেবাস সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান সুশীল তোমার জানিয়েছেন, 'আগামীদিনে পড়ুয়াদের মধ্যে আগ্রহ দেখা গেলে প্রাচীন ভারতীয় গণিত বিষয়ে পৃথক কোর্স তৈরি করা হবে।'

২) কমার্স - কমার্সের ক্ষেত্রে পাঠ্যসূচিতে আসতে চলেছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী বাণিজ্যের ধারণা, প্রাচীন ভারতের গুরুকুল ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে বাণিজ্যের স্নাতক স্তরের পড়ুয়াদের।
৩) অর্থনীতি— পাঠ্যক্রমে থাকবে সম্পদ সংক্রান্ত ধর্মীয় ব্যাখ্যা। পূর্ববর্তী সময়ে সম্পদ উৎপাদনে রাজার ভূমিকাও অন্তর্গত হবে সিলেবাসে।
৪) রসায়ন– ইউজিসি’র নির্দেশিকা অনুযায়ী পরমাণুর ধারণা ভারত থেকেই উদ্ভূত। তাই পড়তে হবে পরমাণুর ভারতীয় ধারণা। অ্যালকোহলিক পানীয় বা সুরা সংক্রান্ত অধ্যায়ে থাকবে কাঞ্জি, মহুয়ার রাসায়নিক গঠন এবং তার গুণাগুণ।
৫) নৃতত্ত্ব— এলওসিএফ ড্রাফট বলছে নৃতত্ত্বকে উপনিবেশবাদের প্রভাবমুক্ত করতে হবে। প্রয়োজন নৃতত্বের ভারতীয়করণ। তাই সিলেবাসে থাকবে চড়ক, সুশ্রুত, বুদ্ধ, মহাবীরের বিভিন্ন উক্তি। সেখান থেকেই নির্ধারিত হবে প্রকৃতি এবং সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক।
৬) রাষ্ট্রবিজ্ঞান— বদলে দেওয়া হচ্ছে বৈষম্যের সংজ্ঞা। কেবল তফসিলি জাতি এবং উপজাতির মানুষের উপর সংগঠিত হওয়া অন্যায়ই গণ্য হবে বৈষম্যের তালিকায়। কল্যাণকর রাষ্ট্রের  উদাহরণ হিসাবে উঠে আসবে রামরাজ্যের কথা। 'ভারতে স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অধ্যায়ের রেফারেন্স হিসাবে পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ব্রিটিশকে ৬ দফায় বারবার মুচলেকা দেওয়া সাভারকারের লেখা, 'দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ার অব ইনডিপেন্ডেন্স'।

বিরোধিতার কারণ
১) গৈরিকীকরণ— বৈদিক যুগের দার্শনিক কণাদ বিশ্বের প্রথম পরমাণু বিজ্ঞানী! প্লাস্টিক সার্জারির পথ চলা শুরু প্রাচীন ভারতের চিকিৎসক সুশ্রুতের হাত ধরে! এমনটাই পড়ানো হয় আরএসএস’র শাখা বিদ্যা ভারতীর পরিচালনায় সারা দেশে চালিত ১২,০০০ স্কুলে। এলওসিএফ ড্রাফটের হাত ধরে সরাসরি সিলেবাসে ঢুকছে এই বিষয়গুলোই। রসায়নের সিলেবাস সংক্রান্ত নির্দেশিকা শুরু হচ্ছে সরস্বতী বন্দনার মাধ্যমে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন কথা। সরাসরি আঘাত নামছে সংবিধান বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতার উপর। হিন্দু রাষ্ট্রের খোয়াব দেখা আরএসএস’র উদ্যেশ্য কচি মাথায় তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি ঢুকিয়ে দেওয়া। তার জন্যই চলছে ত্রিফলা আক্রমণ। 
একদিকে বিভিন্ন সরকারি মহল থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভাজন, বিদ্বেষমূলক বিভিন্ন কথা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথায় বসানো হচ্ছে আরএসএস-এর কর্মীদের। তার সাথেই চলছে সিলেবাসের নির্লজ্জ পরিবর্তন। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতিনিয়ত বিশ্বাসঘাতকতা করা আরএসএস নিজেদের ভাবমুর্তি উদ্ধারের জন্যই পরিবর্তন করছে সিলেবাস । অন্যদিকে মুছে দেওয়া হচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রাম সঞ্জাত ধারণা এবং মূল্যবোধকে। দেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে রুখতে হবে এই অপচেষ্টা। তাই আটকাতে হবে এলওসিএফ’র প্রয়োগ।

২) বিজ্ঞান চেতনার উপর আঘাত—  ৯টি বিষয়ের স্নাতকস্তরের পাঠক্রমের জন্য যে ফরমান জারি করেছে ইউজিসি তার মাধ্যমে সরাসরি আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতার উপর। প্রাচীন ভারতীয় গণিতের কোর্সে ব্যবহৃত হবে, 'সূর্য সিদ্ধান্ত', 'আর্যভট্টীয়', 'সিদ্ধান্ত শিরোমণি' তে উল্লিখিত বিভিন্ন সংস্কৃত ভাষার উক্তি। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের যুগে এই অনুশীলন যে অপ্রাসঙ্গিক তা বলার অবকাশ রাখে না। ম্যানেজমেন্টের অত্যাধুনিক উদ্ভাবনে যখন বাণিজ্য নতুন মাত্রা পাচ্ছে তখন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সময়ের সাপেক্ষে অচল বললে অত্যুক্তি হয় না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কিভাবে মানব কল্যাণে ব্যবহার করা যাবে তা যখন দুনিয়ার আলোচ্য বিষয়, তখন প্রাচীন ভারতের পরমাণু তত্ত্ব নিতান্তই পশ্চাৎপদ। বাম পরিচালিত কেরালা রাজ্য তাদের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে রোবোটিক্স, আর পিছনের দিকে হাঁটতে চাইছে ইউজিসি। বিজ্ঞান আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়। যুক্তির আলোকে শাণিত করতে শেখায় প্রতিটি বিষয়কে। তাই ফ্যাসিস্তদের মূল আক্রমণের লক্ষ্য থাকে বিজ্ঞানচর্চা। ইতালিতে ক্ষমতায় এসে ১৯২৩ সালে জেন্টিলে রিফর্ম দ্বারা এভাবেই বিজ্ঞানচর্চা স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন মুসোলিনি। ফ্র্যাঙ্কোর স্বৈরশাসনে স্পেনে ক্যাথলিক চার্চের কথার বিরোধী হওয়ায় বাতিল হয়েছিল ডারউইনের বিবর্তনবাদ। আজও মোদীর ভারতে একইভাবে ব্রাত্য ডারউইনবাদ। সংবিধানের ৫১এ (এইচ) ধারা অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য বিজ্ঞান চেতনা গড়ে তোলা। কিন্তু এদেশে পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে বিজ্ঞানচর্চাকে। কিছুদিন আগেই জিপমারের নতুন এমার্জেন্সি এবং ট্রমা কেয়ার বিল্ডিং উদ্বোধন করে এমবিবিএস এবং আয়ুশের সংযুক্ত কোর্সের কথা বলে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রতাপরাও যাদব। নতুন করে সিলেবাসের গাইডলাইনে সেই প্রবণতা বজায় রেখে আসলে বিজ্ঞানচেতনের উপর আঘাতকেই ত্বরান্বিত করতে চাইছে ইউজিসি।
৩) কেন্দ্রীকরণ— পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় গাইডলাইনের মাধ্যমে প্রধানত সিলেবাসের মূল বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলেও তার পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্ধারণ করে দেওয়া হতো না। এর অনেকটাই থাকতো রাজ্যের হাতে। স্থানীয় প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু যেমন সংস্কৃতি, প্রকৃতি, জলবায়ু, বৈচিত্রের নিরিখেই নির্ধারিত হতো পাঠক্রম। সাম্প্রতিক এলওসিএফ ড্রাফটের মাধ্যমে সিলেবাসের সমস্তটাই নির্ধারণ করতে চাইছে ইউজিসি। এই প্রবণতা দেশের বহুমাত্রিকতা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর সরাসরি আঘাত হানার চেষ্টা।
৪) পাঠক্রমের ধরন (Course pattern)—  জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী জোর দেওয়া হয়েছে বহুবিষয়ক পাঠক্রমের (multi- disciplinary course) উপর। এলওসিএফ খসড়ায় সমস্ত পাঠ্যক্রমকে ভাগ করা হয়েছে তিন ভাগে। ক) ডিসিপ্লিন স্পেসিফিক কোর, অর্থাৎ মূল বিষয়। খ) ডিসিপ্লিন স্পেসিফিক ইলেকটিভ, অর্থাৎ সেই বিষয়েরই অন্যান্য  বিষয় সম্পর্কে জানা যা ঐচ্ছিক। গ) জেনারেল ইলেকটিভ অর্থাৎ ঐচ্ছিক সাধারণ বিষয়— প্রধান বিষয়ের বাইরে অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত পাঠ্যক্রম।
প্রতিটি বিষয়তেই সিবিসিএস পদ্ধতি অনুযায়ী ক্রেডিট পয়েন্ট নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বিএসসি কেমিস্ট্রির ক্ষেত্রে ক্রেডিট স্কোরের ৯৬ পয়েন্ট বরাদ্দ ডিসিপ্লিন স্পেসিফিক কোরের জন্য। ডিসিপ্লিন স্পেসিফিক ইলেকটিভের জন্য বরাদ্দ ৩২ পয়েন্ট। জেনারেল ইলেকটিভের জন্য থাকছে মাত্র ৯ পয়েন্ট। অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও অনুসৃত হয়েছে এই ধারা। অর্থাৎ মুখে বহুবিষয়ক বললেও আদতে সিলেবাস সাজানো হয়েছে মূল বিষয়কে কেন্দ্র করেই। 
শিক্ষা মহলের প্রতিক্রিয়া
সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার সর্বনাশের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে বিভিন্ন মহল। এলওসিএফ ড্রাফটকে অবৈজ্ঞানিক, অপ্রাসঙ্গিক এবং পশ্চাৎপদ আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে বিভিন্ন ছাত্র শিক্ষক সংগঠন। গোটা দেশ জুড়ে এই ড্রাফটের কপি পুড়িয়ে বিক্ষোভে নেমেছে এসএফআই। বিভিন্ন অ-বিজেপি রাজ্যগুলোর তরফ থেকেই প্রবল বিরোধিতা এসেছে এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। সরাসরি বিবৃতি দিয়ে এর বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়েছে কেরালা সরকার। কেরালা স্টেট হাইয়ার এডুকেশন কাউন্সিলের তরফ থেকে বিশেষ কমিটির উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই সার্কুলার বিশ্লেষণের। একই পথে হেঁটেছে কর্নাটক সরকারও।
NEP, NCF এর ধারাবাহিকতায় LOCF
২০২০ সালে কোভিড অতিমারীর আবহে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় লোকসভায় জাতীয় শিক্ষানীতি পাশ করায় বিজেপি সরকার। বিভিন্ন ছাত্র, শিক্ষক সংগঠন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের ন্যূনতম পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি মোদী সরকার। প্রধানত শিক্ষার বেসরকারিকরণ, গৈরিকীকরণ এবং কেন্দ্রীকরণের নীলনকশা উঠে এসেছিল এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে। সংবিধানের মর্মবস্তু গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দদ্বয়ের কোনও উল্লেখ নেই এই শিক্ষানীতিতে। ভারতের মতন বহুধা বিস্তৃত দেশে তুলে ধরা হচ্ছে, 'এক দেশ, এক বোর্ড’-এর মডেল। শিক্ষানীতির  ফরমান অনুসারে গঠিত হায়ার এডুকেশন কমিশন অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান হবেন নরেন্দ্র মোদী। দানশীল ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের (Philanthropic private investment) এগিয়ে আসার নাম করে আদতে শিক্ষাঙ্গনে আরএসএস’র প্রবেশের রাস্তা উন্মুক্ত করা হয়েছে। ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের বা প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার নামে পশ্চাৎপদ অনেক ধারণা এবং বিষয়বস্তু পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার আভাস ছিল আগে থেকেই। সেই নীতিরই বাস্তবায়ন হতে চলেছে এলওসিএফ’র মাধ্যমে, যার খসড়া প্রকাশিত হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতির পর শিক্ষায় সর্বগ্রাসী আক্রমণের লক্ষ্য নিয়েই মোদী সরকার নিয়ে আসে ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক (এনসিএফ ২০২৩)। পূর্ববর্তী সময়ে ১৯৭৫, ১৯৮৮, ২০০০, ২০০৫ সালেও তৈরি হয়েছিল এনসিএফ। তবে সেক্ষেত্রে সিলেবাসের প্রধান রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল। বাকিটা ছিল রাজ্যের হাতে। কিন্তু ২০২৩ সালে নিয়ে আসা কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক যা কার্যত স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে রাজ্যের অধিকারকে সীমিত করে দেয়। এর আগেও কোভিড অতিমারীর সময়ে সিলেবাস কমানোর নামে পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হয় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইতিহাসে বাদ যায় মুঘল যুগের ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বাদ দেওয়া হয় গান্ধী হত্যা এবং পরবর্তী সময়ে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করার বিষয়, সোশিওলজি থেকে বাদ যায় গুজরাট গণহত্যা সংক্রান্ত রিপোর্ট, রসায়নে বাতিল হয় মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণি, জীবনবিজ্ঞানে উপেক্ষা করা হয় ডারউইনবাদকে। একদিকে আরএসএস’র লজ্জার ইতিহাসকে আড়াল করা, পাশাপাশি সিলেবাসের গৈরিকীকরণ, বিজ্ঞানচেতনার উপর আঘাত ছিল এনসিএফ’র প্রধান লক্ষ্য। যে পরিকল্পনায় এনইপি, এনসিএফ তার ধারাতেই এলওসিএফ’র প্রস্তাবনা।
একদিকে ' হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তানের' একমাত্রিকতার দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়া অন্যদিকে দেশের বেচে, সরকারি নীতির নামে লুটের সুযোগ করে কর্পোরেট তোষণ। এই ছকেই দেশের দখল নিতে চাইছে বিজেপি। সেই প্রয়াসের অঙ্গ হিসাবেই আক্রমণ শিক্ষার উপর। বিভাজনের যে বিষ প্রচারে তুলে ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি, যে ঔদ্ধত্যের সাথে অস্বীকার করে বিজ্ঞানকে– তাকেই পাঠক্রমে নিয়ে এসে বৈধতা দিতে চায় নয়া ফ্যাসিবাদ। এসআইআর’র মাধ্যমে যে বিযুক্তির পদ্ধতি চলে ভোটার তালিকায় তার ‘সম্মতি উৎপাদক যন্ত্র’-এ পরিণত করতে চায় পাঠক্রমকে। সিলেবাসের এই পরিবর্তনের প্রচেষ্টা আসলে দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুমাত্রিকতা, বৈজ্ঞানিক মননের উপর আঘাত। এলওসিএফ’র বিরুদ্ধে তাই জনমত গঠন করা প্রয়োজন দেশকে রক্ষার জন্যই। প্রবল বিরুদ্ধতার প্রতি আক্রমণেই পরাজিত করতে হবে নবীন প্রজন্মের মগজ ধোলাইয়ের অপচেষ্টাকে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গড়ে উঠুক ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য ব্যারিকেড।
 

মন্তব্যসমূহ :0

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন