ভ্রমণ
মুক্তধারা
খেরোর খাতায় ঔরঙ্গাবাদ
অভীক চ্যাটার্জী
১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩
Every block of stone has a statue inside it and it is a task of a sculptor to discover it. — MICHELANGELO
এই বিস্তীর্ণ পর্বতমালা, এই সবুজ অরণ্য বনানী, এই বর্ষণমুখর দ্বিপ্রহর যেনো এক মহাকাব্যিক সমাপতন। আর আমরা একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি সেই মহাকাব্যের রসাস্বাদন করতে।
আমি এর আগেও বেশ কিছু বৌদ্ধ গুহা বা লেনি দেখেছি। মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে এরকম গুহা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বেডসে কিম্বা কারলা লেনী এগুলোর মধ্যে বেশ পরিচিত। এগুলো তৈরির একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল। প্রথমে বৌদ্ধ স্থপতি কোনো একটি জায়গাকে নির্বাচন করতেন। তারপর সেখানে একটু ছোট্ট গুহা কেটে রেখে দিতেন বছরের পর বছর। শুধু এটুকু দেখতে, যে পরিবেশ এই গুহার দেয়ালে কি ছাপ ফেলছে এবং এই গুহা যদি বিহারে রূপান্তরিত করা হয়, তা দীর্ঘমেয়াদি হবে কি না। তারপর সে জায়গা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্বাচনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেতো, সেখানে নির্মাণ শুরু হতো সেই অমিতসুন্দর চৈত্য গৃহ, মঠ ও বিহার।
প্রতিটি গুহাই যে মন্দির, তা কিন্তু নয়, যেমন গুহা নং ১ হলো একটি বিহার। এগুলো মূলতঃ ৫ম থেকে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে তৈরি। আবাসিক শ্রমনদের আবাসস্থল হলো এই বিহার। সেই ভাবেই মঠ, সভাগৃহ(মহার্ঘার) , স্তম্ভশোভিত বারান্দা,ধ্যানকক্ষ, গ্রন্থাগার, চৈত কক্ষ মায় দ্বিতল বা তৃতল বিশিষ্ট আবাসস্থল, সবই এই বিশাল কমপ্লেক্সে বিদ্যমান। জলের জন্য বিশাল রিজার্ভারও রয়েছে দেখলাম।তবে সব চেয়ে আশ্চর্য করে দেওয়ার মত যে বিষয়টা লক্ষ্য করলাম, সেটা হলো স্পেস ম্যানেজমেন্ট। আর সব জায়গাতেই বেশ বুদ্ধিমত্তার সাথে শিল্পের ছোঁয়া। সে ছোঁয়ায় কখনও জেগে উঠেছেন অভয়মুদ্রায় তথাগত কখনও বা বোধীবৃক্ষের নিচে স্বয়ং সিদ্ধার্থ আবার কখনও শুধুই জাতকের গল্পের কোনো এক বিশেষ মুহূর্ত। দেখতে দেখতে কখন যেনো হারিয়ে গেলাম আমরা আজ থেকে প্রায় দেড়হাজার বছর আগের এক অজানা বৌদ্ধ মঠে। প্রত্যক্ষ করতে শুরু করলাম তাদের রোজনামচা। ছোট ছোট কুঠুরির মধ্যে ধ্যানমগ্ন শ্রমণ, কার্যনির্বাহী ভিক্ষু কিম্বা মঠ অধ্যক্ষ লামারা সবাই যেন জীবন্ত হয়ে উঠল আমার মনশ্চক্ষে। কি অদ্ভুত এক শৃঙ্খলায় মানুষ দিনাতিপাত করে চলতো এই মঠে। প্রতিটি কক্ষ প্রতিটি গুহা তার নিজস্বত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর। যেখানে একসময় মুখরিত হতো ছোট্ট শ্রমণদের
কোলাহল, কিম্বা ভিক্ষুদের জলদগম্ভীর কণ্ঠের ওম মানিপদ্মে হুম, সেখানে আজ বয়ে যায় রিক্ত হাওয়ার স্রোত। বয়ে চলে জীবন্ত ইতিহাসের পাতার ছেঁড়া টুকরো। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে যায় ঝরা সময়ের উপাখ্যান।
গুহা নং ১৩ থেকে শুরু হয় হিন্দু গুহা। যেগুলোকে শৈব গুহাও বলা যেতে পারে। তবে এখানে আমি বিষ্ণুর দশবতার গুহাও দেখেছি। তবে যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা, সবচেয়ে বেশি উৎসাহ সেটি হলো কৈলাশ মন্দির। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মনোলিথিক রক কাট্ মন্দির হলো আমাদের এই কৈলাশ মন্দির। আমি যখন এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন আমার আশ্চর্য হওয়ার অনেক বাকি রয়ে গেছে। উপর থেকে কাটতে কাটতে নিচে নেমে আসা এই মন্দিরের প্রথম ধাক্কা লাগে এর প্রযুক্তিসৈলীর কথা চিন্তা করলে। প্রথমে এর প্ল্যানিং যখন হয়েছিল, তখনই নির্ভুল ভাবে মেপে নেওয়া হয়েছিল, ঠিক কোনখানে কতটা কাটা হবে এবং ঠিক কি ভাবে কাটা হবে। কোনো জায়গাতেই কোনো আপোষ করা হয়নি এই মন্দিরে। তার সেতু, বারান্দা, গর্ভগৃহ,চূড়া সবই আছে। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের হলো এর স্তম্ভ এবং কারুকার্য। মন্দিরটি দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতির পিঠে। এবং প্রতিটি হাতির মাপ গুণে গুণে সমান। আর কারুকার্যের কথা যতই বলা যাক, কম বলা হবে। শুধু এটুকু বলতে পারি, এ যেনো এক চিরন্তন। ঠিক যেমন চাঁদ যেমন সূর্য যেমন ধ্রুবতারা, ঠিক তেমনি এই মন্দিরও রয়ে গেছে অনন্তকাল ধরে। কারণ যখনই আমি ভাবতে যাই এই মন্দির মনুষ্য সৃষ্ট, তখনই চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যায়। ধাক্কা খায় আমার বাস্তববাদী মন। তাই একে চিরকালীন বলে বিশ্বাস করতেই ইচ্ছে করে। আবার ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। আমরা এগিয়ে চললাম জৈন গুহাগুলোর দিকে।
চলবে
Comments :0