আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণি, শ্রমজীবী মানুষের কাছে শপথ নেবার দিন। এই বছর ভারতে মে দিবস পালনের শতবর্ষ। ১৯২৩ সালে তদানীন্তন মাদ্রাজে মে দিবসের লাল পতাকা তুলেছিলেন এম সিঙ্গারাভেলু।
এই ১০০ বছর ধরে চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে ভারতের শ্রমিকশ্রেণির লড়াই চলেছে, চলছে, ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে।
মে দিবস আরও একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে বিশ্ব পুঁজির আগ্রাসী চরিত্র। প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে শ্রমশক্তি লুট করে মুনাফার পাহাড় গড়ছে বৃহৎ পুঁজির মালিকরা। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির গ্রাসে প্রায় সব দেশের উৎপাদন ও পরিষেবা। পুঁজির কেন্দ্রীভবন অব্যাহত। তার অনিবার্য ফল হিসাবে বৈষম্য নজিরবিহীন চেহারা নিয়েছে। এমনকি পুঁজিবাদের সমগ্র ইতিহাসে এইরকম তীব্র বৈষম্য আগে দেখা যায়নি। ভারতেই তার প্রমাণ রয়েছে।
১ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পদের ৬০ ভাগ জমা হয়ে গেছে। বিশ্বজুড়েই পুঁজিবাদ কর্মহীনতার সঙ্কটের জন্ম দিচ্ছে। বিপুল তরুণ প্রজন্মের হাতে কাজ নেই। পৃথিবীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ক্ষুধা, অত্যন্ত কম আয় ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। পুঁজিবাদ মানবসভ্যতার বিপদ, তা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে আরও একবার প্রমাণিত হচ্ছে।
পুঁজিবাদ এমনকি নিজের সঙ্কটেরও মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। মন্দার কবলে পড়েছে। উৎপাদনে সঙ্কটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক ক্ষেত্রের গভীর সঙ্কট। একের পর এক ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতেই পড়তে বাধ্য। এই সঙ্কটে প্রমাণিত হয়েছে নয়া উদারনীতির চরম ব্যর্থতা। এক দশক আগেও নয়া উদারনীতির পক্ষে যারা সওয়াল করতেন, এখন তারা মূর্খ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এই সঙ্কটের গুরুতর সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছে অতি দক্ষিণপন্থার উত্থানে। ইউরোপের অনেক দেশেই অতি দক্ষিণপন্থীরা জায়গা দখল করছে। আমেরিকা, লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে অতি দক্ষিণপন্থীরা ফের তৎপর হয়েছে।
ভারতেও সাম্প্রদায়িক শক্তি গণতান্ত্রিক রাষ্টের বদলে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাচ্ছে। পুঁজিবাদের সঙ্কটে দিশাহীন মানুষকে ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে সমবেত করা, উগ্র সংখ্যালঘু ও অভিবাসী বিরোধিতা সব দেশেই উগ্র দক্ষিণপন্থার অভিন্ন বৈশিষ্ট্য। এই শক্তি শ্রমিকশ্রেণির শত্রু।
বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণি বিনা প্রতিরোধে তাদের ওপরে আক্রমণ মেনে নিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, গ্রিস, ইতালি সহ একের পর এক দেশে বিক্ষোভ ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন শ্রমিকশ্রেণি। অর্জিত অধিকার রক্ষায় তারা পথে নেমেছে। ফ্রান্সে এই লড়াই দীর্ঘস্থায়ী চেহারা নিয়েছে।
ভারতেও এই সময়পর্বে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন বৃহত্তর চেহারা নিয়েছে। একদিকে কর্পোরেটের অবাধ মুনাফার জন্য নীতি প্রণয়ন করছে কেন্দ্রের সরকার, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদকে লুট করা হচ্ছে, শ্রমজীবীর অধিকারকে ক্রমশ সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে, শ্রমিকশ্রেণি সর্বভারতীয় স্তরে এবং শিল্প ও ক্ষেত্র ভিত্তিক লড়াই গড়ে তুলেছে। সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণির পাশাপাশি এই লড়াইয়ে ক্রমশ শামিল হচ্ছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীরা।
শুধু তা-ই নয়, শ্রমিকের সঙ্গে গ্রামীণ শ্রমজীবী, কৃষক ও খেতমজুরদের আন্দোলনের ঐক্য গড়ে উঠছে। দিল্লিতে সাম্প্রতিক সমাবেশ এই যৌথ শক্তির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। বিকল্প নীতির ভিত্তিতে লড়াই গড়ে তুলে শ্রমিক-বিরোধী, জনবিরোধী, দেশবিরোধী মোদী সরকারকে হটানোর লক্ষ্যে মানুষকে সমবেত করাই এই মে দিবসের প্রধান শপথ।
পশ্চিমবঙ্গেও শ্রমিকশ্রেণি আক্রমণের মুখে। শিল্প বন্ধের প্রায় এক যুগ চলছে, শ্রমিক ছাঁটাই চলছে, কর্মসংস্থান নেই, চাকরি চুরির মহোৎসব চলেছে। গড়ে উঠছে জন অসন্তোষ। তাকে সঠিক দিশায় প্রবাহিত করার জন্য আরও তীব্র সংগ্রাম গড়ে তোলা প্রয়োজন। মে দিবসে রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ সেই দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেবার শপথ নেবেন।
Comments :0