বাংলার মাটিতে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে তৃণমূল এবং বিজেপি’র সাজানো মেরুকরণ ভাঙছে। মঙ্গলবার সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সাংবাদিক বৈঠক করে এই মন্তব্য করে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র বেহাল দশা, দলের ভিতরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, মারামারি চলছে। সেই সঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি’র নকল লড়াই মানুষও বুঝতে পারছেন। বামেরা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠছে দেখে আরএসএস এবং মমতা ব্যানার্জি মিলে নকল যুদ্ধ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। সেই জন্যই বিবেকানন্দকে নিয়ে স্রেফ চালাকি করছে ওরা। ভুলে গেছে, বিবেকানন্দই বলেছিলেন, ‘চালাকির দ্বারা কোনো মহৎ কার্য হয় না।’
অমিত শাহ আর জে পি নাড্ডা কলকাতায় এসে বিজেপি’র অভ্যন্তরীণ কলহ সামলাতে লোকসভা নির্বাচনের জন্য একটি দলীয় কমিটি গড়েছেন। এই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেলিম বলেছেন, দলের হাল যদি এতই ভালো তাহলে দিল্লি থেকে বিজেপি নেতাদের এনে এমন কমিটি গড়তে হচ্ছে কেন? কেন দলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদেরও এই কমিটিতে রাখেনি? ওইসব মন্ত্রী এবং এরাজ্যের বিজেপি নেতারা অপদার্থ বলে অমিত শাহরা বুঝতে পেরেছেন, এখন দলকে চাঙ্গা করতে নিজেরা এসে বিপদ সঙ্কেত দিচ্ছেন। সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, মিডিয়া, ধর্ম, সবকিছু ব্যবহার করেও বিজেপি এরাজ্যে ক্রমশ গলে যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে মারামারি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দক্ষিণবঙ্গে বিজেপি চুরমার, উত্তরবঙ্গেও ভেঙে যাচ্ছে।
শুধু গোষ্ঠীকোদলে চুরমার দশাই নয়, এরাজ্যে তৃণমূল বিরোধিতার নকল লড়াই ধরা পড়ে যাওয়াতেও মানুষ বিজেপি’কে পরিত্যাগ করছে বলে মন্তব্য করেছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, এরাজ্যের মানুষের তৃণমূল বিরোধী স্বাভাবিক ক্ষোভের সুযোগ নিয়েছিল বিজেপি। ছাপান্ন ইঞ্চি দিয়ে নবান্নকে শায়েস্তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু মানুষ সত্যিটা ধরে ফেলেছে, তাঁরা বুঝে গিয়েছেন ২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় আসার পরেই এরাজ্যে তৃণমূল নেতাদের সম্পদ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বাংলার মাটিতে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে ওদের সাজানো মেরুকরণ ভাঙছে, বেকার যুবরা, শ্রমিক, কৃষক, অত্যাচারিত নারী পুরুষ সবাই এখন ইনসাফ চাইছেন।
বুধ ও বৃহস্পতিবার সিপিআই(এম)’র রাজ্য কমিটির বৈঠক হবে। সেলিম জানিয়েছেন, নভেম্বর মাসের গোড়ায় রাজ্য কমিটির বর্ধিত অধিবেশনের পরবর্তী সময়ের আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচির পর্যালোচনা, সংগঠন ও আগামী কর্মসূচি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে। ইনসাফ চেয়ে বাংলার যৌবনের ডাকে ৭ জানুয়ারি মানুষের ঢল নামবে ব্রিগেডে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যোগসাজশ করে তা আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু যে কোনও মূল্যে ব্রিগেডের সমাবেশ হবে।
সেলিম বলেছেন, বামেরা সবল হচ্ছে দেখে মন্দের ভালো তৃণমূলকে রাখতে চাইছে আরএসএস। তারা বহুমাত্রিক রাজনীতি করে, বহু দলে ও সংগঠনে আরএসএস’র লোক ঢুকিয়ে রাখে। তৃণমূলকে ভিত্তি করে এরাজ্যে সংগঠনকে বাড়াতে চাইছে আরএসএস। মুখ্যমন্ত্রীও দিল্লিতে গিয়ে ভাইপো’কে বাঁচানোর ব্যবস্থা করে এসেছেন, ইডি-সিবিআই এরাজ্যে শীতঘুমে চলে গিয়েছে। অন্য রাজ্যে ইডি-সিবিআই তল্লাশি চালায়, গ্রেপ্তার করে, এরাজ্যে তৃণমূল নেতাদের কেবল ডেকে পাঠায়। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের গায়ে যাতে আঁচড় না লাগে তার জন্য হাতে ‘কিডস গ্লাভস’ লাগিয়ে কাজ করছে ইডি-সিবিআই।
সেলিম বলেন, এর আগে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে সামনে রেখে, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে এরাজ্যের রাজনীতিতে তৃণমূল বনাম বিজেপি মেরুকরণ করা হয়েছিল। তারপরে নেতাজীর নামে স্লোগান জয় শ্রীরামের স্লোগানে বদলে গেছে, বিদ্যাসাগরের নামে যারা স্লোগান দিয়েছিল তারা বিদ্যা আর শিক্ষা দুটোই লাটে তুলেছে। এখন বিবেকানন্দকে দেখিয়ে বাঙালি সাজার চেষ্টা করছে। বিবেকানন্দ ভারত পথিক ছিলেন, গোটা দেশকে উপলব্ধি করেছিলেন। ধর্মের নামে বর্ণের নামে ভাগাভাগির বিরুদ্ধে ছিলেন। ভারতের এই বৈচিত্রকে রক্ষার জন্যই বামপন্থীরা সংগ্রাম করছেন।
শুধু হিন্দু-মুসলমানে নয়, তৃণমূল এবং বিজেপি বাঙালি ও অবাঙালির নামেও বিভাজনের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে অর্জুন সিং’কে দিয়ে কী করানো হচ্ছে? কে বাঙালি, কে বিহারী, কে হিন্দু, কে মুসলিম এগুলি চোখে আঙুল দিয়ে চেনানো হচ্ছে, কিন্তু অর্জুন সিং তৃণমূল না বিজেপি সেটা কেউ চেনাতে পারছে না। বাঙালি-বিহারী ভাগের চেষ্টা করছে, কিন্তু বিহারের নীতীশ কুমার সরকার কীভাবে অস্থায়ী শিক্ষকদের স্থায়ী করতে পারছে সেটা দেখে শিখছে না।
আগামী লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা জানিয়ে সেলিম বলেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করতে ১৭৬ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, বিজেপি বিরোধী সর্বভারতীয় মঞ্চ ইন্ডিয়া সারা দেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছে। সাসপেন্ড হওয়া সাংসদদের মধ্যে তৃণমূলের সাংসদও রয়েছেন, কিন্তু তৃণমূল কি প্রতিবাদে নেমেছে? সাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রবিরোধী বিজেপি’র বিরুদ্ধে নীতির লড়াইতে নেমেছে? নীতি নিয়ে লড়তে রাজি নয়, ওরা কেবল নেতা বাছাইয়ের কথা বলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য না থাকা সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেলিম বলেছেন, তৃণমূল আর বিজেপি’র কাছে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, আগামীদিনের রিয়েল এস্টেট। সরকারি শিক্ষা পরিকাঠামো ধ্বংস করে কর্পোরেট হাতে দিতে চায়। কোনও সরকার যে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করতে চায়, সেই প্রতিষ্ঠানকে কর্তৃপক্ষহীন করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে উপাচার্যহীন রেখে সেটাই করা হচ্ছে।
Comments :0