Editorial

অন্ধকার গহ্বরে সংবাদমাধ্যম

সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial

ভারতের বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যম নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠে গেছে। মুদ্রণ মাধ্যম, বৈদ্যুতিন মাধ্যম, ডিজিটাল মাধ্যম কাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, কাদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকদের মধ্যেও। লোকনীতি-সিএসডিএস ’র রিপোর্ট ‘মিডিয়া ইন ইন্ডিয়া: ট্রেন্ডস অ্যান্ড প্যাটার্নস’-এ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে সাংবাদিকদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মনে করেন রাজনৈতিক ভাবে সংবাদমাধ্যম পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে উঠেছে। ৮২ শতাংশই বলেছেন তাঁরা যে মিডিয়া সংস্থায় কাজ করেন, তারা বিজেপি’র প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। শুধু ইংরেজি মাধ্যমের মিডিয়ার ক্ষেত্রেও ৮০ শতাংশ সাংবাদিক বলেছেন, সংবাদমাধ্যম বিজেপি’র হয়ে কাজ করছে। মোদীর হয়ে ‘অতিরিক্ত আনুগত্য’ দেখানো হচ্ছে বলে ৮০ শতাংশ সাংবাদিকই অভিমত দিয়েছেন। তেমনই বিরোধী দলগুলির প্রতি অতিরিক্ত বৈরিতা দেখানো হচ্ছে বলে ৬১ শতাংশ মনে করেছেন। 


যাঁরা এই সমীক্ষায় উত্তর দিয়েছেন তাঁরা সংস্থায় কর্মরত। এই নয় যে তাঁরা সকলে মিলে বিজেপি’র প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছেন। তাঁরা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে চাইলেও উপায় নেই। সংস্থার সম্পাদকীয় নীতির পরিধির মধ্যেই তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে। বস্তুত এই সমীক্ষায় উত্তরদাতা সাংবাদিকদের ১৬ শতাংশ বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে তাঁদের কাজ ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে। স্পষ্ট ভাবে ১৬ শতাংশকে বলা হলেও ৫০ শতাংশের বেশি সাংবাদিক উদ্বিগ্ন যে একই কারণে যে কোনো সময় তাঁদের কাজ চলে যেতে পারে। বলা বাহুল্য, এই কাজ চলে যাওয়া বা চলে যাবার আশঙ্কায় রয়েছেন তাঁরাই যাঁরা উদারনৈতিক, প্রগতিশীল, অ-সাম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে খবর করা জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমে এক প্রকার নিষিদ্ধই হয়ে গেছে। 
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অন্যতম সূচক। এই সূচকে ভারতের অবস্থানের দ্রুত অবনতি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ৭২ শতাংশ সাংবাদিকই মনে করছেন সংবাদ চ্যানেলগুলি এখন আগের থেকে কম স্বাধীন। শুধু বৈদ্যুতিন চ্যানেলেই নয়, মুদ্রণ মাধ্যমেও ৫৫ শতাংশ সাংবাদিক মনে করছেন ‘নিজেদের কাজ যথাযথ করার মতো স্বাধীনতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে’। 


স্বাভাবিক ভাবেই পেশা হিসাবে সাংবাদিকতার আর আগের মতো সম্ভ্রম ও সম্মান নেই বলেও সাংবাদিকরাই মনে করছেন। ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করছেন নিউজ চ্যানেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁরা ‘খুবই নিরাশাবাদী’। ইংরেজি মাধ্যমের সাংবাদিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই জানিয়েছেন, গত দু’বছরে বিভিন্ন সময়ে কাজ ছেড়ে দেবার কথাও ভেবেছেন। ‘পেশা সম্পর্কেই গভীর অসন্তোষ’ রয়েছে বলে রিপোর্টের উপসংহার। 
বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন কর্পোরেট মালিকানায় পরিচালিত। কর্পোরেট মালিকদের স্বার্থ এবং সংবাদমাধ্যমের নীতি একাকার হয়ে যাচ্ছে। মূল অসুখ এখানেই। এই প্রবণতা এখন উৎকট চেহারায় নিজেকে প্রকাশ করছে। ভারতের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনের বাস্তবতা সংবাদমাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে না। গণ মাধ্যম এখন আর ‘গণ’ মাধ্যম নেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শাসকের নিয়ন্ত্রণ। সংবাদমাধ্যমে সেন্সরশিপের চেহারা বদলেছে। এক বড় অংশের সংবাদমাধ্যম এখন মোদী-স্তুতিতে বাধ্য। তাদের ওপরে এমন চাপ তৈরি করা হয়েছে এবং আনুগত্যের গভীরতা এমন পর্যায়ে গেছে যে ‘গোদী-মিডিয়া’ বলে একটি কথা চালু হয়ে গেছে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পরিসর ক্রমশ কমছে। শুধু শাসক দলের অন্ধ আনুগত্যই নয়, সংবাদমাধ্যমকে বাধ্য করা হচ্ছে ভুয়ো খবর এমনকি ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে। তথ্য প্রযুক্তি আইনের যে সংশোধনী আনা হয়েছে তার ফলে ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর খবর তুলে নেবার নির্দেশ দিতে পারে সরকার। ‘জাতীয় স্বার্থের’ অজুহাত দেখিয়ে এই সেন্সরশিপের কাঠামোগত ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সরকার যে সরাসরি হুমকি দিচ্ছে তা টুইটারের প্রাক্তন সিইও জ্যাক ডোরসি জানিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে কৃষক আন্দোলনের সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন খবর টুইটারে পোস্ট হলে সংস্থাকে বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে, কর্মীদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের মধ্যেই যে নৈরাশ্য ও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে তা সংবাদমাধ্যমের ভবিষ্যতকে আরো বিপন্ন করছে।


 

Comments :0

Login to leave a comment