SHIBPUR CLASH ANALYSIS

ধরনা ফ্লপ, লড়াই যখন বাড়ছে, তখনই শিবপুর

রাজ্য জেলা

bjp tmc communal polarisation bengali news তৃণমূল বিজেপিকে অক্সিজেন দিতেই শিবপুরে দাঙ্গা সংগঠিত করার চেষ্টা

মমতার দু’দিনের ধরনা পুরোপুরি ফ্লপ। ঠিক সেই বিকালেই শিবপুরের ঘটনা। 

শিবপুরে বৃহস্পতিবার হিন্দুত্ববাদীদের হাঙ্গামা যখন হলো, তখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাস দুয়েক বাকি।
মমতা ব্যানার্জি ‘চোর ডাকাত’ বলার পরও প্রাপ্য ডিএ’র দাবিতে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন ভাঙেনি। আরও বড় সমাবেশ করেছেন তাঁরা— বৃহস্পতিবারই। মমতা দিন-রাত এক করে ধরনা দিলেন ৩০ ঘণ্টা। হুঙ্কার দিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর যা বলার নয়, যে ভাষায় বলার নয়, তাও বললেন। কিন্তু ধরনা জমলো না।

বিজেপিও রাজ্যে হালে পানি পাচ্ছে না। তৃণমূলকে মানুষ ‘চোর’ বলছে। এমন সময়ে শিবপুর-কাণ্ড।
বসিরহাটে দাঙ্গা হয়েছিল গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের এক বছর খানেক আগে। ২০১৭-র জুলাইয়ে। বসিরহাটে দাঙ্গা হয়েছিল যখন, তার এক বছর আগে বিধানসভায় দ্বিতীয়বারের জন্য জিতেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের বোঝাপড়ায় প্রায় ৭৭টি আসনে জিতেছিল। বিজেপি ৩টির বেশি আসন পায়নি। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মজুরি, কাজ, পঞ্চায়েতে তৃণমূলের বেপরোয়া লুটের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করছিলেন বামপন্থীরা। সেই সময়ে বিজেপি’র পালে হাওয়া তুলতে বসিরহাটের দাঙ্গা।


বসিরহাটে দাঙ্গা ছড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছড়ানো একটি ভিডিও। এবার হিন্দুত্ববাদীরা রামনবমীর মিছিলকে উত্তেজনা তৈরির কাজে ব্যবহার করল। রাজ্যে রামনবমীর মিছিলকে উৎসাহিত করেছে তৃণমূল। অস্ত্র হাতে শাসক দলের নেতারা রামনবমীর মিছিল করছেন, রাজ্য দেখেছে কয়েক বছর আগেই। এবারও অর্জুন সিংয়ের মতো তৃণমূলের অনেক নেতাই রামনবমীতে উগ্র মিছিলের আয়োজক ছিলেন।

এবার মোদীর নীতির বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন। জিনিসের দাম লাগাতার বাড়ছে। কাজ নেই। শিক্ষার সুযোগও কাড়তে নেমেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার— জাতীয় শিক্ষানীতির নামে। অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জির দলের বিরুদ্ধে ‘চোর তাড়িয়ে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ো’— বামপন্থীদের এই অভিমুখে পরিচালিত লড়াই গ্রামে গ্রামে সাহস জোগাচ্ছে গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষকে। রেগার কাজ নেই একবছরের বেশি। রাজ্যে অন্য কোনও কাজের সুযোগ মমতা ব্যানার্জির সরকার তৈরি করতে পারেনি। কৃষকের ফসলের দাম নেই। সংখ্যালঘুসহ গরিব, মধ্যবিত্ত গ্রামবাসীরা ফুঁসছেন— প্রমাণ দিয়েছে সাগরদিঘির উপনির্বাচন।  

বিজেপি রাজ্যে হালে পানি পাচ্ছেনা। অমিত শাহ্‌ রাজ্যে এসে দলের নেতাদের বলে গেছেন, লাল ঝান্ডাওয়ালদের পক্ষে এত লোক যাচ্ছেন কী করে? এমন সময়ে বিজেপি’র দরকার হিন্দুত্বর নামে উত্তেজনা। তাদের ক্রমাগত ছেড়ে যাওয়া মানুষকে যাতে হিন্দুত্বের নামে ফেরানো যায়। মানুষকে ভাগ করা। এমন সময়ে তৃণমূলের দরকার এটি প্রমাণ করা যে, রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের রক্ষাকর্তা শুধু তারাই।

 পাশাপাশি, চাকরি-বালি-কয়লাসহ সবকটি ক্ষেত্রে যে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে জোরদার হয়ে ওঠা আন্দোলনকে ধর্মের নামে ভাগ করতে পারলে মমতা ব্যানার্জিরও সুবিধা।

অবস্থা যে কতটা বেহাল— দু’দিনের ধরনা তা স্পষ্ট করে দিল।

শিবপুরের ঘটনা এমন সময়ে ঘটার সমাপতন নেহাত কাকতালীয় নয়। 


কী বলেছেন মমতা ব্যানার্জি? মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবার বলেছেন, ‘‘আমরা কেউ বসে নেই। আমরা কেউ হাতে চুড়ি পরে বসে নেই।’’ রাজ্যের গ্রামে, শহরে চুড়ি পরা নারীরা মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দুর্বল। তিনি দারুণ শক্তিশালী। তাই তাঁর দাবি, ‘‘আমার উপর আস্থা রাখুন। আমি প্রপার অ্যাকশান নেব। আমার দিকে তাকিয়ে থাকুন। আমি কী অ্যাকশান নিই, আপনারা দেখুন।’’

তিনি আগে থেকে শিবপুরে দাঙ্গার চক্রান্তের আঁচ পেয়েছিলেন, তবু কোনও ব্যবস্থা নেননি। এখন বলছেন, ‘‘আমার উপর আস্থা রাখুন।’’ নিজেকে দারুণ সংখ্যালঘুপ্রেমী প্রমাণ করার জন্য এদিন মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘‘কিন্তু ওরা ( মুসলিমরা) কিছু করেনি। কালকে। কালকে ওরা কিছু করেনি। কালকে একতরফা হয়েছে। আমি জানি, ওদের মধ্যে রাগ আছে, দুঃখ আছে, ক্ষোভ আছে। রমজান মাসে ১ মাস ওরা উপোস করে। ওরা এমন কিছু করে না, যেটা বেআইনি হয়।’’


মানে কী? এই এক মাস ছাড়া সংখ্যালঘুরা বেআইনি কাজ করে!

এদিন বলেছেন, ‘‘কোনও ক্রিমিনালকে রেয়াত করব না। আমি ক্রিমিনালদের প্রশ্রয় দিই না।’’ বসিরহাটের সময় কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, ‘‘সীমান্ত পেরিয়ে ওপার থেকে লোক ঢোকানো হয়েছিল দাঙ্গা করতে।’’ কী কথা দিয়েছিলেন সেই সময়?


বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ওই এলাকায় দাঙ্গা শুরু হয় ২০১৭-র ৫ জুলাই। চলেছিল এক সপ্তাহের বেশি। অনেক গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মমতা ব্যানার্জি একটি বিচারবিভাগীয় কমিশন গড়েছিলেন। 

১৫ জুলাই রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর এই সংক্রান্ত একটি নোটিফিকেশন জারি করেছিল। প্রথম শুনানির দিন থেকে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। কারা ওই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পিছনে ছিল, তা খুঁজে বের করাই ছিল কমিশনের কাজ।

তারপর সেই কমিশনের রিপোর্ট কোথায় গেল? আজ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পরেও সেই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসেনি। সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে কখনও মমতা ব্যানার্জি জানাননি।


দাঙ্গার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে কখনও ব্যবস্থা নেয়নি রাজ্য সরকার। তাই গত বারো বছরে বসিরহাট, ধুলাগোড়ের মতো অনেকগুলি জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। মমতা শাসনেই রাজ্যে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির। দাঙ্গা তারাই করে।
 

Comments :0

Login to leave a comment