১১২ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট শনিবার কলকাতা কর্পোরেশনে পেশ করেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। বাজেট বক্তৃতায় মেয়র, এবং পরবর্তীতে সেই বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে উঠে তৃণমূলের একাধিক মেয়র পারিষদ সদস্য এবং কাউন্সিলর বলেছেন, ‘‘কলকাতা কর্পোরেশন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান নয়। প্রয়োজনে ধার নিয়ে সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দিয়ে থাকে কর্পোরেশন। একটি উন্নয়নশীল দেশের শহরের ক্ষেত্রে এই ভূমিকা অস্বাভাবিক নয়।’’
কিন্তু ঘাটতি বাজেটে, ধার করে মানুষকে পরিষেবা দিতে চাওয়ার বাজেটে দেওয়া হিসেব থেকে স্পষ্ট, গত আর্থিক বছরে বস্তি উন্নয়ন, নিকাশি, স্বাস্থ্য, জল সংযোগের মত একাধিক বিভাগে বরাদ্দ খরচ করে উঠতে পারেনি কর্পোরেশন। এমনকি ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে কর্পোরেশনের আনুমানিক লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪৫৪০.৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু সেই পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৩৮৭১.৬৯ কোটিতে।
বর্তমান আর্থিক বছরে এই সমস্ত বিভাগে কয়েকশো কোটি টাকা করে বরাদ্দ করেছে তৃণমূলের বোর্ড। কিন্তু সেই টাকাও খরচ করা সম্ভব হবে কিনা, উঠছে সেই প্রশ্ন।
শনিবারের পেশ করা বাজেট অনুযায়ী, কর্পোরেশনের তরফে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০৫৪.৫২ কোটি। ব্যায় ধরা হয়েছে ৫১৬৬.৫২ কোটি। ঘাটতির পরিমাণ ১১২ কোটি টাকা। কর্পোরেশনের পুঞ্জিভূত ঘাটতির পরিমাণ ২০২৩-২৪ সালে ছিল ১৯৬২.৯০ কোটি টাকা। ১১২ কোটি টাকা যোগ হলে সেটা বেড়ে দাঁড়াবে ২০৭৪.৯০ কোটি টাকায়।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার সময়ে কর্পোরেশনের হাতে ৫৫০ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোসিট ছিল। সেই পরিমাণ বাড়ানো দূরে থাক, বর্তমানে ফিক্সড ডিপোসিটের পরিমাণ শূন্যে এসে ঠেকেছে।
২০২৪-২৫ সালের বাজেট বিবরণ বলছে, বিগত আর্থিক বছরে জলের সংযোগের খাতে বরাদ্দ ছিল ৪৩১.৮৯ কোটি টাকা। এক বছরে মাত্র ৩০৯.১৫ কোটি খরচ করতে পেরেছে কর্পোরেশন। আগামী আর্থিক বছরে এই বিভাগে বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ৪৪৪.৯৭ কোটি। নিকাশি খাতে ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে বরাদ্দ হয়েছিল ৩০৬.৭২ কোটি। কিন্তু খরচ হয়েছিল মাত্র ২৩৬.৯৩ কোটি। ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ৩৩৫.৬৯ কোটি। সড়ক বিভাগের ক্ষেত্রে ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩৪০.৭০ কোটি। খরচ হয়েছিল ২৬৬.৮০ কোটি। এইবার সেই বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ৩১৮.২২ কোটি। কঠিন বর্জ্য বিভাগের জন্য আগের আর্থিক বছরে বরাদ্দ হয়েছিল ৬৪৪.৫৫ কোটি। কিন্তু কর্পোরেশন খরচ করতে পেরেছিল মাত্র ৫৫৩.৮৬ কোটি। ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের জন্য এই বিভাগে বরাদ্দ করা হয়েছে ৬৬৬.৬৬ কোটি।
কর্পোরেশনের ব্যর্থতার জ্বলন্ত উদাহরণের সাক্ষর রয়েছে বস্তি উন্নয়নের খতিয়ানে। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে এই খাতে বরাদ্দ হয়েছিল ২০৬.৯৪ কোটি। কিন্তু কর্পোরেশন খরচ করতে পেরেছিল মাত্র ১২৫.০১ কোটি। আগামী বছরের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৩২.৬৯ কোটি। কিন্তু এক্ষেত্রেও প্রশ্ন থাকছে, গালভরা বরাদ্দ বাড়ালেও, কতটা খরচ করে উঠতে পারবে কলকাতা কর্পোরেশন।
একই ধরণের গাফিলতির নজির রয়েছে কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের রিপোর্টেও। এই খাতেও পুরো বরাদ্দ খরচ করতে না পারার ‘দক্ষতা’ দেখিয়েছে তৃণমূল পরিচালিত কর্পোরেশন। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ১৮১.৫৩ কোটি। কিন্তু খরচ হয়েছে মাত্র ১৫৮.৯৫ কোটি। আগামী আর্থিক বছরে বরাদ্দ হয়েছে ১৮৬.৫৫ কোটি।
এখানেই শেষ নয়। ঐতিহাসিক গুরত্ব থাকা বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার, বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প, মেয়রের হাতে থাকা উন্নয়নের ফান্ড সহ একাধিক খাতেও বরাদ্দ খরচ করে উঠতে পারেনি কলকাতা কর্পোরেশন।
সহজ অঙ্ক বলে, চাহিদা থাকলেই বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রশাসনের তরফে। বর্তমান কর্পোরেশনের বোর্ডই গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ বাড়িয়েছে। অর্থাৎ সরকারি ভাবে স্বীকার করা হয়েছে যে বস্তি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, নিকাশি, জলের সংযোগের মত বিভাগে কর্পোরেশনের হস্তক্ষেপের বিপুল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু শহরের সমস্ত মৌলিক পরিষেবা প্রদানকারী দপ্তরে বরাদ্দ খরচ করতে না পারার অর্থ, প্রশাসনিক ভাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন ফিরহাদ হাকিম।
এই প্রসঙ্গে কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘বাজেটে বরাদ্দ করেও যদি খরচ করতে না পারে, তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে মানুষকে বোকা বানাতে বরাদ্দ দেখানো হয়েছিল। প্রচারের জন্য দেখানো যে আমরা এত টাকা দিয়েছি। কিন্তু সেই টাকাটা কাজে লাগানো গেল না। এটা বর্তমান কর্পোরেশনের অপদার্থতা ছাড়া কিছুই নয়।’’
Comments :0