এলাকার মানুষ থেকে শুরু করে কলকাতা কর্পোরেশনের বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকরা স্পষ্ট বলছেন, গোটা কর্পোরেশন এলাকা জুড়ে বেআইনি নির্মাণকে বৈধতা দিয়েছে তৃণমূল বোর্ড। তারফলে কলকাতা কর্পোরেশনের সংযুক্ত এলাকা ও পুরনো শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রমরমা বেড়েছে বেআইনি নির্মাণের।
কর্পরেশনের মেয়র ফিরহাদ হাকিম গোটা ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন বামফ্রন্টের সময়কালকে। একইসঙ্গে তাঁর যুক্তি, ‘‘শহরের কোন গলির ভিতরে কি হচ্ছে তা দেখা সম্ভব নয়। অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিই।’’
১৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কলকাতা বন্দর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। সেই আসনের বিধায়ক খোদ ফিরহাদ হাকিম। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শামস ইকবাল । তিনি কলকাতা কর্পোরেশনে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন অধিবেশনে কোটি টাকা দামের গড়ি চড়ে এসে। যেখানে কাউন্সিলরদের ভাতা মাসে ১০ হাজার টাকা। এই অঞ্চল থেকেই ইডি বাজেয়াপ্ত করেছিল ১৭ কোটি টাকা। ২০২২ সালে। অভিযোগ উঠেছিল, সেই টাকার সঙ্গে বেআইনি নির্মাণের যোগ রয়েছে।
কলকাতার প্রাক্তন মেয়র এবং সিপিআই(এম) সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এর পালটা বলেছেন, ‘‘বামফ্রন্টের সময়কালে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ এলেই সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হত। নির্দেশ অমান্য করলে অবৈধ নির্মাণ ভেঙে ফেলা হত। চিত্তরঞ্জন এভিনিউ—এর বেআইনি বাড়ি ভাঙতে গিয়েছিল বামফ্রন্ট। সেই সময় মমতা ব্যানার্জি বিক্ষোভ দেখিয়ে বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে দেননি। বস্তুত সেই সময় সমস্ত রকমের বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করতে সফল হয়েছিলাম আমরা। নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্তরাও নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন, বেআইনি নির্মাণ করা যাবে না, এবং করলে অনুমোদনও মিলবে না কোনও স্তরে।’’
সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, ‘ ১৯৯০’র দশক থেকে বেআইনি নির্মাণের উপর রাশ টানার কাজ শুরু হয়। একসময় শহরে নির্মাণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে নির্মাণ আইন সংশোধন করা হয়, যাতে বৈধ অনুমতি সহজে পাওয়া যায়। একইসঙ্গে বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থার কথা বলা হয়।’’
২০১০ সাল থেকে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে কর্পোরেশন। শহরে ফের বাড়তে শুরু করে অবৈধ নির্মাণ।
বিকাশ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘বামফ্রন্টের সময়কালে বেআইনি নির্মাণ ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক জরিমানা ও কারাদণ্ডের উদাহরণ রয়েছে। এখন কাউন্সিলররা স্কোয়ারফুট মেপে কাটমানি খান। মেয়রের অফিস থেকে বেআইনি নির্মাণকে ছাড়পত্র দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তাঁকে দেখাদেখি আধিকারিকদের একটা অংশও কাটমানি খেয়ে অবৈধ নির্মাণকে ছাড়পত্র দিচ্ছেন।’’
গোটা ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘ সিবিআই তদন্ত হলেই বেরিয়ে আসবে কাউন্সিলররা কাটমানি হিসেবে কত টাকা নিজেরা খেয়েছেন, আর কত টাকা তাঁরা কালীঘাটে জমা দিয়েছেন।’’
কর্পোরেশনের আধিকারিকদের একটা অংশও বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত। তাঁরা বলছেন, ‘‘শহরে তৃণমূলের কাউন্সিলরদের আয়ের প্রধান উৎস বেআইনি নির্মাণ। প্রতি স্কোয়ার ফুট মেপে টাকা তোলেন তাঁরা। এরসঙ্গে স্থানীয় থানাকেও যুক্ত করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী ভাগ বাটোয়ারা হয়।’’
কলকাতা কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য, ‘‘বামফ্রন্টের সময়কালে বেআইনি নির্মাণ রোধে বিশেষ বিভাগ ছিল কর্পোরেশনের। সেখানে কলকাতা পুলিশের মতো কঠিন শারীরিক মাপকাঠির ভিত্তিতে কর্পোরেশনের সার্জেন্ট নিয়োগ হত। দিনের বেলায় তাঁরা বেআইনি বাড়ির সামনে মোতায়েন থেকে নির্মাণ আটকাতেন। রাতে থানার পুলিশ মোতায়েন হত। সার্জেন্ট মোতায়েনের জন্য খরচ দিতে হত বেআইনি নির্মাতাকেই। নিয়ম ভেঙে বারবার নির্মাণ করতে সেই খরচও বাড়ত। তৃণমূল বোর্ড এই বিভাগকেই তুলে দিয়েছে।’’
তুলে দেওয়ার ফলে কি হয়েছে?
ইঞ্জিনিয়াররা বলছেন, ‘‘এখন কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারদের দায়িত্ব শুধু নোটিশ দেওয়া এবং অবৈধ অংশটুকুর নকশা এঁকে আদালতে জমা দেওয়ার। আগে ড্র্যাফ্টসম্যান ছিল। এখন সেই কাজও করতে হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারদের। রোজ মামলার শুনানিতে হাজিরা দিতে হচ্ছে মিউনিসিপ্যাল কোর্টে। একেকজন সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারকে একাধিক ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে যিনি রয়েছেন, তিনি আরও ২টি ওয়ার্ডের দায়িত্বে। কর্পোরেশনকে বলা হলেও লোক নিয়োগ হচ্ছে না। কাজের অতিরিক্ত চাপে নজরদারিতে ফাঁক থেকে যাচ্ছে।’’
আর সেই নজরদারির ফাঁককে ব্যবহার করা হচ্ছে বেআইনি নির্মাণের জন্য। একরকম প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে।
কলকাতা শহরের অবসরপ্রাপ্ত নগর পরিকল্পক দীপঙ্কর সিনহা বলছেন, ‘‘বেআইনি নির্মাণের জন্য একদিকে কর্পোরেশনের রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে। অপরদিকে পরিকল্পনার বেশি মানুষ এক জায়গায় থাকার ফলে পানীয় জল ও নিকাশির উপরেও চাপ পড়ছে। চাপ পড়ছে জঞ্জাল নিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও। আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বেআইনি নির্মাণ প্রমাণিত হলে ভেঙে ফেলা হত। এখন সেটাকে জরিমানার বদলে রেগুলারাইজ করা হয়। ৪ তলা বাড়ির ভিতে ৬ তলা বাড়ি তৈরি করে, সেটাকে টাকা দিয়ে রেগুলারাইজ করলেই কি ৪ তলার ভিত বেড়ে ৬ তলার ভিত তৈরি হয়ে যাবে? না বাড়িতে লোহার পরিমাণ বাড়বে? নির্মাণের স্থায়িত্ব বাড়বে?’’
আধিকারিকদের বক্তব্য,‘‘ কাউন্সিলররা কার্যত ‘আড়কাঠির কাজ করেন। তাঁরা টাকা তুলে, নিজেদের জন্য একটা অংশ রেখে বাকিটা ‘উপর মহলে’ পাঠিয়ে দেন। থানাও নিজেদের সদর্থক ভূমিকা পালন করে। এই বোঝাপড়ার অংশ হিসেবে অবৈধ নির্মাণকে টাকার বদলে রেগুলারাইজ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। নির্মাতারাও জানেন, নিয়ম ভেঙে বাড়ি বানালে কোনও শাস্তির মুখে পড়তে হবে না। বাড়ি ভাঙাও পড়বে না।’’
Comments :0