Primary School Job Scam

অভিষেকের অফিসে নিয়োগ দুর্নীতির টাকা নিয়মিত পাঠাতেন বিজেপি নেতা

রাজ্য

চার্জশিটে বিস্ফোরক অভিযোগ। নিয়োগ দুর্নীতির চক্রে এজেন্স হিসাবে কাজ করা বিজেপি নেতা অযোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা নিয়ম করে পাঠাতেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থার অফিসে! এমনই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ রয়েছে প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে সিবিআই’র তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে। 
চার্জশিটে স্পষ্ট অভিযোগ করা হয়েছে, সেই বর্তমান বিজেপি নেতা মূলত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকুর এজেন্ট হিসাবেই কাজ করতেন। শুধু প্রাথমিকের নিয়োগে নয়, এসএসসি’র গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি, নবম দশমের সহকারী শিক্ষক, শারীর শিক্ষা, কর্মশিক্ষায় নিয়োগের দুর্নীতিতেও কালীঘাটের কাকুর হয়ে টাকা তুলতেন সেই ব্যক্তি। প্রাইমারি এবং এসএসসি মিলিয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি পাইয়ে দিতে সুপারিশের ভিত্তিতে মেধাতালিকা বিকৃত করে ৭৮ কোটি টাকা তুলেছিলেন সেই বিজেপি নেতা। সেই টাকাই এরপর মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির  ঠিকানাতে জন্ম নেওয়া পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’র বর্তমানের নিউ আলিপুরের ঠিকানার অফিসে পাঠাতেন ওই বিজেপি নেতা।
শাসক তৃণমূলের এজেন্ট চক্রের মূল মাথা বর্তমানে বিজেপি নেতা। আর সেই নেতাই হাজার হাজার পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে অবৈবভাবে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে তোলা কোটি কোটি টাকা পাঠাতেন লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’র অফিসে! এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো, তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বানার্জি। 
প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় গত ২১ ফেব্রুয়ারি নগর দায়রা আদালতে সিবিআই’র তরফে এই সাপ্লিমেন্টরি চার্জশিট দায়ের করা হয়েছিল। তিনজনকে অভিযুক্ত হিসাবে দেখানো হয়েছে। কালীঘাটের কাকু ছাড়াও রয়েছে হুগলীর তৃণমূল নেতা শান্তনু ব্যানার্জি এবং অরুণ হাজরা। তৃতীয় নামটি নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে এই চার্জশিটের মাধ্যমেই প্রথম সামনে আসে। একদা তৃণমূলের নেতা, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-তে যোগ দেন অরুণ ওরফে চিনু হাজরা। নিয়োগ দুর্নীতিতে শাসক তৃণমূলের এজেন্টের ভূমিকায় টাকা তুলতেন এই চিনু হাজরা।
চার্জশিটের ১৪ নম্বর পাতায় ১৭.১৩ অনুচ্ছেদে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে, অরুণ হাজরা সে সময় কালীঘাটের কাকুর এজেন্ট হিসাবে প্রাথমিকে ও এসএসসি’তে অযোগ্য চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে ৭৮ কোটি টাকা তুলেছিলেন। এর মধ্যে ১১ কোটি ৫০ টাকা প্রাথমিকে অযোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন স্তরে দিতে হয়েছিল। 
চার্জশিটে এরপরের অনুচ্ছেদেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, অযোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে তোলা টাকা এরপর অরুণ হাজার সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রকে সরাসরি অথবা তাঁর অফিসের কর্মী নিখিল হাতির মাধ্যমে পাঠাতেন। তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্য, এই চিনু হাজরার অধীনেও আবার একাধিক সাব-এজেন্ট কাজ করতেন। মূলত অযোগ্য প্রার্থীদের তালিকা ধরে টাকা তোলার কাজ। সেই সাব-এজেন্টরা কত টাকা প্রার্থী পিছু তোলা হলো, কত টাকা কালীঘাটের কাকু এবং চিনু হাজরাকে পাঠানো হলো সেসবই ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। তদন্তকারী চলাকালীন সিবিআই’র আধিকারিদের হাতে এমন প্রায় ১০টি ডায়েরি আসে। চিনু হাজরার সাব এজেন্ট শেখ আব্দুল সালাম, বকুল বিশ্বাস, রওসান আলম, ত্রিস্তান মান্নাকে জেরা করে সেই তথ্য মেলে। সেই ডায়েরিগুলিও বাজেয়াপ্ত করা হয়।
সেই জেরা পর্ব ও ডায়েরি থেকে মেলা তথ্যে জানা যায় ওই সাব-এজেন্টরা টাকা তুলে প্রথমে অরুণ হাজরাকে পাঠাতেন। তারপর তাঁর নির্দেশেই সেই টাকা  পাঠাতে হতো কালীঘাটের কাকু অথবা তাঁর অফিসের কর্মী নিখিল হাতির কাছ। মূলত তিনটি ঠিকানায় এই সাব এজেন্টরা নগদ টাকা পৌঁছে দিতে। কালীঘাটের কাকুর বেহালার বাড়িতে, বেহালার একটি ক্লাবে এবং নিউ আলিপুরের ঠিকানায় লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অফিসে। দফায় দফায় ৭৮ কোটি টাকা পাঠানো হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের সঙ্গে অভিষেক ব্যানার্জির সম্পর্ক নেই এমন দাবি কি তৃণমূলের পক্ষে তোলা হবে? লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অফিসেই নিয়োগ দুর্নীতির কোটি কোটি নগদ টাকা পাঠানো হত এবং তা কি জানতেন না অভিষেক ব্যানার্জি? 
মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির ঠিকানাতেই ওই সংস্থার পথ চলা শুরু। অভিষেক ব্যানার্জি ২০১৪ সালে সাংসদ হওয়ার পরে  পদত্যাগ করেন লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড থেকে। বর্তমানে অভিষেক ব্যানার্জির বাবা-মা’ই  এই সংস্থার অন্যতম দুই ডিরেক্টর। অমিত ব্যানার্জি ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি এই সংস্থার বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে যোগ দেন। লতা ব্যানার্জি ১৯ এপ্রিল ২০১২ সালে অর্থাৎ কোম্পানির তৈরি সময় থেকেই ছিলেন। রুজিরা ব্যানার্জিও একসময় ছিলেন এই সংস্থার বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে। 
লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের আরেকটি সংস্থা রয়েছে। সেটি হলো ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’। অবশ্য কয়লা পাচার কাণ্ড ও শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে সিবিআই এবং ইডি তদন্ত চলাকালীন এই সংস্থার পাততাড়ি গোটানো শুরু হয়েছে। আরওসি’র তথ্য বলছে এই সংস্থার বর্তমান স্ট্যাটাস, ‘আন্ডার প্রসেস অফ স্ট্রাইক অফ’! এই সংস্থার ডিরেক্টরও দু’জন— লতা ব্যানার্জি ও অমিত ব্যানার্জি। শুধু তাই নয় ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অফিসে দফায় দফায় তল্লাশি অভিযানের পরে ইডি’র তরফে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল তাতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি এই সংস্থার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও)! যদিও গত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দাখিল করা হলফনামায় লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের কোনও উল্লেখ ছিল না। 
সিবিআই’র এই তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে। প্রাইমারি এবং এসএসসি’তে অবৈধ নিয়োগের জন্য চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে যে ৭৮ কোটি টাকা কালীঘাটের কাকু বিজেপি নেতা চিনু হাজরা ও তাঁর সাব এজেন্টদের মাধ্যমে তুলেছিলেন। টাকা দিয়েও শেষমেশ চাকরি পাননি এমন ব্যক্তিদের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ফেরত দিতে হয়েছিল কালীঘাটের কাকুকে। তার জন্য আবার বেহালার ম্যান্টনে কালীঘাটের কাকু তাঁর সংস্থা ও পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা প্রায় ৩০ কাটা জমি বিক্রিও করেন।

Comments :0

Login to leave a comment