ALIPORE JAIL MUSEUM

ইতিহাস নিয়ে ছেলেখেলা আলিপুর জেল মিউজিয়ামে

রাজ্য

ALIPORE JAIL MUSEUM INDIAN INDEPENDENCE MOVEMENT HISTORY

‘‘আচ্ছা, এই ‘আজাদ হিন্দ’টা তো ৩৯৯টাকা। এতে কী কী থাকছে?

-      এতে আপনি লুচি, বাসন্তী পোলাও, মাটন কষা পাবেন।

-      ওরে বাবা! অত খেতে পারবো না, আর দামটাও...।  এই ‘বিনয়-বাদল-দীনেশ’টা বেশ সস্তা দেখছি। এতেই বা কী কী থাকছে? আর দুজনের কুলোবে তো?’’

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল মিউজিয়ামের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত  ‘একান্তে কিচেন’ নামের একটি রেস্তোরা। আগে সেখানেই জেল হাসপাতাল ছিল। সেই ভবনের একতলায় তৈরি হয়েছে এই রেস্তোরা। মঙ্গলবার সেখানেই কানে এলো এক মহিলার সঙ্গে রেস্তোরা কর্মীর এই কথোপকথন।

ঠিক কোন বিষয়ে কথা বলছেন ওই দু’জন?

রেস্তোরার কর্মচারীদের কথায়, এখানে চারটি প্ল্যাটার পাওয়া যায়। রেস্তোরায় খেতে আসা মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘আমেজ’ দিতে এই প্ল্যাটার চারটির নাম দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে ‘আইএনএ স্পেশ্যাল প্ল্যাটার’, ‘সিপাই বিদ্রোহ প্ল্যাটার’, ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ প্ল্যাটার’ এবং ‘বিবিডি প্ল্যাটার’। এই প্ল্যাটারগুলির দামের তারতম্য রয়েছে, এবং এরমধ্যে কোনটিতে মাছ পাওয়া যায় তো, কোনটিতে খাসি কিংবা মুর্গির মাংস। নিরামিষাশী ক্রেতাদের জন্য রয়েছে ‘বিবিডি প্ল্যাটার’।

আজাদ হিন্দ ফৌজের উর্দির মতো দেখতে পোষাক পরা এক কর্মচারীকে এই রেস্তোরার মেনু কার্ড চাইতে তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে ‘অফিসে’ চলে গেলেন। ফিরে এসে জানালেন, আপাতত মেনুকার্ড দেওয়া হচ্ছে না। তবে প্ল্যাটারগুলো আছে। মুখেমুখেই খাবারের অর্ডার দিতে হবে।

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার সকাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে জেল মিউজিয়ামের এই মেনু কার্ড। এবং চারটি প্ল্যাটারের নাম দেখে ক্ষোভ উগড়ে দিতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। সেইজন্যেই কি মেনুকার্ড আপাতত হাতে দেওয়া হচ্ছে না?

এই প্রশ্নটি করাতে কার্যত শুনতে না পাওয়ার ভঙ্গিতে চলে যান কর্মচারিটি। অপর এক কর্মী জানান, ‘‘সকাল থেকে আমাদের বলে দিয়েছে, কেউ যেন মেনুকার্ডের ছবি না তোলে। কিন্তু ওভাবে কি কাউকে আটকাতে পারি আমরা? তাই মেনুকার্ড দেওয়া বন্ধ রয়েছে। মনে হয় কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে।’’ 

এই ‘কিছু একটা গন্ডগোল’ কেবলমাত্র রেস্তোরাতেই সীমাবদ্ধ নেই।

নবনির্মিত এই সংগ্রহশালার ছত্রে ছত্রে রয়েছে ইতিহাসকে লঘু করার প্রচেষ্টা। চড়া রঙের প্রলেপে অতীতকে মুছে খেলার, ইতিহাসকে গুলিয়ে দেওয়ার ছাপ সর্বত্র। এর হাতে গরম প্রমাণ মিলেছে সংগ্রহশালার একটি প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীতে ভগৎ সিং, অরবিন্দ ঘোষ, চন্দ্রশেখর আজাদের সঙ্গে একই বন্ধনীতে রয়েছে ব্রিটিশরাজের কাছে ৬বার মুচলেকা দেওয়া মোদীগুরু ‘বীর’ সাভারকরেরও নাম। এর পাশাপাশি মিউজিয়ামের বই বিপণিতে দেখা মিলেছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের লেখা বইয়ের পাহাড়। 

একান্তে কিচেনের অদূরেই বন্দীদের একটি ব্যারাককে প্রদর্শনশালায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। সেই ব্যারাকের সামনের লনে ঠাঁই মিলেছে দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজোমন্ডপের প্রতিমার। মিউজিয়ামের অন্দরসজ্জা বাড়ানোর নামে সেই মন্ডপের থিমের কিছু অংশকেও ‘বেঢপ’ভাবে ব্যারাকের সামনে খাড়া করা হয়েছে। 

ইংরেজ আমলে ফাঁসিকাঠে প্রাণ দেওয়া বিপ্লবীদের নামের নির্ভুল তালিকা প্রকাশ করতেও ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য। শহীদ বিপ্লবীদের নামের তালিকা থেকে প্রাথমিক ভাবে বাদ গিয়েছিল চারুচন্দ্র বসু( ১৯ মার্চ, ১৯০৯)’র নাম। পরবর্তীকালে টনক নড়ায় তালিকার একদম শেষে আলকাতরা দিয়ে তাঁর নাম জোড়া হয়েছে। মিউজিয়ামে প্রবেশের জন্য সাধারণের থেকে বেশ চড়া হারেই শুল্ক আদায় করছে রাজ্য। তারপরেও ত্রুটিহীন নতুন ফলক লাগিয়ে উঠতে পারেননি মিউজিয়ামের দায়িত্বে থাকা সরকারি আধিকারিকরা

হেরিটেজ রক্ষা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস প্রসারের নামে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলকে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করেছে রাজ্য সরকার। গত ২১ সেপ্টেম্বর মিউজিয়াম উদ্বোধনের পর থেকেই জনতার ঢল নেমেছে সেখানে। কিন্তু সেই মিউজিয়ামের একাধিক কর্মকান্ড দেখে আপত্তি প্রকাশ করতে শুরু করেছেন ইতিহাসপিপাসু দর্শনার্থীরা। তাঁদের অভিযোগ, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যকে মেলে ধরার বদলে স্বাধীনতা আন্দোলনের গরিমাকে কলুষিত করছে এই মিউজিয়াম। ইতিহাসকে কার্যত লঘু করা হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। 

Comments :0

Login to leave a comment