দিন দশেক আগেই দিল্লির এক জনবহুল রাস্তায় নমাজীদের লাথি মারার জন্য বিক্ষোভের চাপে সাসপেন্ড করা হয়েছে দিল্লি পুলিশের এক অফিসারকে। এবারে একই রকম হিংস্র আক্রমণের শিকার হলেন গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিদেশি পড়ুয়া। শনিবার রাতে হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-ব্লক হস্টেলে ঢুকে ছাত্রদের নমাজে বাধা দেয় একদল বহিরাগত। তারা রীতিমতো মারধর করে ওই বিদেশি শিক্ষার্থীদের। ওই শিক্ষার্থীরা আত্মরক্ষার জন্য বাধা দিলে দু’পক্ষের মধ্যে মারপিট, ধস্তাধস্তি হয়। এর পাশাপাশি হস্টেল লক্ষ্য করে বাইরে থেকে দেদার ঢিল ছোঁড়া হয়েছে বলেও জানা গিয়েছে। তারই জেরে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন শ্রীলঙ্কা থেকে আসা দু’জন এবং তাজিকিস্তান থেকে আসা এক ছাত্র। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ তিন জনকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারীকেও মারধর করেছে বহিরাগতরা। এই হামলা চালানোর সময়ে বহিরাগতদের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে।
এই ঘটনায় আবারও হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডবে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটল হিংসাত্মক চেহারায়, এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্য বিজেপি-শাসিত গুজরাটে। জানা গিয়েছে, মুসলিম ছাত্রদের উপর হিন্দুত্ববাদীদের এই আক্রমণের সময়ে তাদের ছোঁড়া ঢিলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হস্টেলের ঘর, একাধিক বাইক ও ল্যাপটপ। গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশী পড়ুয়া আছেন প্রায় ৩০০ জন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৭৫ জন থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-ব্লক হোস্টেলে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং পরিকল্পনামাফিক এই আক্রমণ চালানো হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ।
এদিকে ভোটের মুখে এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে এই ঘটনায় রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়েছে মোদী সরকার। এমনিতেই বিদেশ নীতিতে একাধিক গলদ থাকায় প্রতিবেশী একাধিক দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন সমস্যার মুখে। তারই মধ্যে বিদেশি ছাত্রদের জড়িয়ে এই ধরনের লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে মোদীর সাধের গুজরাটে, যা আসলে বিজেপি-সঙ্ঘের কাছে হিন্দুত্বের গবেষণাগার। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সেই সম্পর্ক সংক্রান্ত সমস্যাকে এই হামলা আরও জটিল করে তুলতে পারে এবং ভোটেও তার প্রতিফলন ঘটতে পারে বলে মুখরক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছে রাজ্যের বিজেপি সরকার ও পুলিশ প্রশাসন। রবিবার পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে তড়িঘড়ি এক বৈঠকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন গুজরাটের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হর্ষ রমেশ সঙ্গাভি। অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে ২০ থেকে ২৫ জনের বিরুদ্ধে। যুগ্ম পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে নয়টি তদন্তকারী দল। রবিবার এমনই জানিয়েছেন আমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার জি এস মালিক। রবিবার রাত পর্যন্ত হীতেশ মেওয়াডা ও ভরত প্যাটেল নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে আমেদাবাদ পুলিশের অপরাধ দমন শাখা। বাকি অভিযুক্তদেরও ভিডিও থেকে শনাক্ত করে ধরার জন্য পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে শিক্ষার্থীদেরই দু’দলের মধ্যে সংঘর্ষ বলে আখ্যা দিলেও ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, প্রথম থেকেই আক্রমণ ছিল একতরফা। এর পাশাপাশি দুই ধৃতর কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদতে অভিযোগের গুরুত্ব শিথিল করে অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে কি না, উঠেছে সেই প্রশ্ন।
ধৃতদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করা হলেও তাদের মধ্যে প্রায় সবকটিই জামিনযোগ্য বলে জানা গিয়েছে। একদিকে বিদেশে সরকারের মুখরক্ষা, অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক ও বাহক হলেও ভোটের আগে সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সামলানো, এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতেই তদন্তে লোকদেখানো সক্রিয়তা রেখে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নরম ব্যবস্থা গ্রহণ করছে রাজ্যের বিজেপি সরকার— এমনই মনে করছেন একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। প্রধানমন্ত্রী ও গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং গুজরাট থেকেই রাজ্যসভায় নির্বাচিত বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন সোস্যাল মিডিয়ায়। উল্লেখ্য, বিজেপি-আরএসএস’র রাজত্বে জনমানসে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে তীক্ষ্ণ করার প্রবণতা বেড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। এর পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের স্বাভাবিক ধর্মাচরণের সাংবিধানিক অধিকারকে জোর-জুলুম খাটিয়ে কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টাও রোজ বেড়েই চলেছে। দশ দিনের মধ্যে উত্তর ভারতের দুই জায়গায় একই রকম ঘটনা এই সত্যকেই আবারও প্রমাণ করল।
Foreign Students Gujarat
হস্টেলে ঢুকে হিন্দুত্ববাদী হামলা নমাজে, আহত ৩ বিদেশী ছাত্র
×
Comments :0