উলট পুরাণ
অনল শর্মা
১৭ এপ্রিল থেকে ১৩ জুন। ওই এপাং ওপাং ঝপাং।
সময়টা ১৯৭৮। তার আগে কোনদিন গ্রামের মানুষ ভাবেনি গ্রামের দেখভালের দায়িত্ব তাদের। তাদের ঠিক করা লোকেরাই চালাবে গ্রাম। শুধু গ্রাম না গ্রামের সঙ্গে ব্লক আর তার সঙ্গে সঙ্গে জেলা। খোদ জেলাশাসক বসতে বাধ্য হবেন কোন গ্রামের রাখাল মাহাতো বা রহিম সরদারের সঙ্গে। কোন কাজ আগে হবে, কাজের দায়িত্ব কে পাবে? সব ঠিক করবে গ্রামের মানুষ সরাসরি। আর তাতেই যেন মান সম্মান সব খুইয়ে ফেলল এতদিনকার মৌরসি পাট্টার মালিক রা।
কাজেই তাদের হয়ে গোসা করার লোকের তো অভাব নেই। কলম তৈরি । কাগজও তৈরি । লিখে ফেললেই হয়।
লেখা হয়ে গেল।
"পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য শুধু ভোটপত্রই ছাপিতে হইবে সাত কোটি । কোন কালে কবি লিখিয়াছিলেন সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী। আজ এত ভঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ। তবুও তাহার পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাত কোটি ভোটপত্রের প্রয়োজন পড়িতেছে।"
লেখার শিরোনাম' পঞ্চায়েতের ভোট এবং ঘোট ' । ছাপা হয়েছিল সর্বাধিক জনপ্রিয় সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে। ১৭ ই এপ্রিল ১৯৭৮।
সাত কোটি ভোটপত্র কেন? কারন গ্রাম পঞ্চায়েতের আসন সংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার ৪৮৫ , পঞ্চায়েত সমিতির ৮৫১৫, জেলা পরিষদের ৬৫০। সবচেয়ে বেশি আসন ছিল ২৪ পরগনা আর মেদিনীপুরে। সেদিন কেউ কেউ বলেছিলেন দলহীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন এই প্রত্যক্ষ নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করবে। পরের কথা সকলের জানা।
নির্বাচন ঘোষণার পরবর্তী পরিস্থিতি লক্ষ্য করে উনিশে এপ্রিল ওই কাগজেই লেখা হলো ১৮ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে চলেছে। বিভিন্ন সময়ে রাজ্য মন্ত্রিসভা নানা-অজুহাত দেখিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ব্যবস্থা করেনি অধিকাংশ পঞ্চায়েত আজ সাইনবোর্ড হয়ে রয়েছে আর তাই এই নির্বাচন নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা ভারতবর্ষের কোন রাজ্যে নেই। তবুও ওই টিপনি কাটার জায়গাটা কিন্তু বন্ধ হল না। বলা হলো সরাসরি দলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন মানে গ্রামাঞ্চলে নিচু স্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দলীয় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা। আর সে সময় বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীতে নির্বাচনী জনসভায় বলছেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। " গণতন্ত্রের জন্য দলের প্রয়োজন আছে । রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্রের কথা অর্থহীন। সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য দলের প্রয়োজন । কোন এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় পরিবর্তন আসতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন সমষ্টিগত উদ্যোগ । আর তা একক প্রচেষ্টায় কখনোই সম্ভবপর নয়।"
চৌঠা জুন হল নির্বাচন। জেলা পরিষদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন ২৪৪৭ জন। পঞ্চায়েত সমিতিতে ২৬ হাজার ৫২৫ জন। আর গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে এক লক্ষ ৩৭ হাজার ৩৪৭ জন। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল বামফ্রন্ট সব স্তরেই সফল।
আর এরপরেই সেই উলট পুরান। ১৩ ই জুন ওই কাগজে প্রকাশিত হলো এক সম্পাদকীয় । শিরোনাম জন্মান্তর।
" পঞ্চায়েত মানে গণতন্ত্রকে একেবারে নিচের তলা হইতে তৈরি করা। এতদিন যে তন্ত্র বহাল আছে বা ছিল তাহা উপর হইতে আরোপিত। ভিত্তি ভূমি না থাকলে সৌধ আর মিনার মিথ্যা হইয়া যায়। সেই জন্যই এবারের ভিত্তি স্থাপন। পঞ্চায়েত কে পুনরজ্জীবন সাধুবাদ জানাই। জনগণের সচেতন রাজনৈতিক বোধকেই কুর্নিশ। গ্রামের সাধারণ মানুষেরা কি এই নির্বাচনেরই অপেক্ষায় ছিলেন? হয়তো তাহাই। ভোটের হার সেই ইচ্ছার দিকে ইঙ্গিত করিতেছে। আবাল বৃদ্ধ বণিতা বিপুল সাড়া দিয়েছে।"
উলট পুরান ই সত্যি হোক এবার ও।
Comments :0