Uruguay election

উরুগুয়েতে রাষ্ট্রপতি হলেন বামপন্থী ওরসি

আন্তর্জাতিক

  ‘‘এখানে অনেকে তরুণ। তাদের যখন আমার মতো বয়স হবে, এক সম্পূর্ণ আলাদা জগতে তারা বসবাস করবেন।’’ রবিবার গভীর রাতে মন্টেভিডিও’র এক জনসভায় উচ্ছসিত কন্ঠে এমনটাই জানিয়েছেন একসময়কার কমিউনিস্ট গেরিলা ও উরুগুয়ের কিংবদন্তী বামপন্থী রাষ্ট্রপতি, নব্বুই ছুঁইছুঁই জোসে মুজিকা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় ‘ছাত্র’-কে অভিনন্দন জানাতেই এই সভায় উপস্থিত হয়েছেন ‘পেপে’ মুজিকা। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসে ছেয়ে গেছে গোটা দেশ। গ্রাম শহরের খেটে খাওয়া মানুষ, তরুণ সমাজ ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের বড় অংশের সম্মিলিত কন্ঠে উঠে এসেছে সমস্বরে উঠে এসেছে, ‘আমরা আদায় করতে জানি’। এই স্লোগানকে সামনে রেখেই পাঁচ বছরের দক্ষিণপন্থী শাসনে ইতি টেনে উরুগুয়েতে ক্ষমতায় ফিরলেন বামপন্থীরা। রবিবার গভীর রাত পর্যন্ত টানটান লড়াইয়ের পর ৫২.০৮ শতাংশ পেয়ে জয়ী হয়েছেন ব্রড ফ্রন্ট (ফ্রেন্তে অ্যামপ্লিও)-র রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ইয়ামান্ডু ওরসি। দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল পার্টির নেতৃত্বাধীন রিপাবলিকান কোঅ্যালিশান’র প্রার্থী আলভারো দেলগাডো পেয়েছেন ৪৭.৯২ শতাংশ ভোট। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে ভোটবাক্সে জনসাধারণের সরকার বিরোধী ক্ষোভ উপচে পড়েছে।
মেক্সিকো, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, চিলে, ইকুয়েডরের মতো আরও বেশ কয়েকটি দেশের পর লাতিন আমেরিকায় নয়া-উদারবাদীদের শেষ ঘাঁটিগুলির মধ্যে একটিও বেদখল হলো। শনিবার ভোটদানের পর থেকে শুরু হয় গণনা। ফলপ্রকাশের প্রথম রাউন্ডে ওরসি ও তাঁর উপ রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ক্যারোলিন কোস ৪৩.৮৬ শতাংশ ভোট পেয়ে অন্য সমস্ত প্রার্থীদের থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিলেন। তবে এদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা অনুযায়ী কোন প্রার্থী ৫০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট না পেলে জিতবেন না। সেই বাবদ সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে এগিয়ে থাকা ওরসি ও দেলগাডোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে। দ্বিতীয় রাউন্ডের গণনা শেষে দেখা যায়, প্রায় ১২ লক্ষ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন ওরসি-কোস জুটি। রবিবার রাতে হার স্বীকার করে ওরসিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বিদায়ী শাসক দল ন্যাশনাল পার্টির প্রার্থী আলভারো দেলগাডো। 
বিদায়ী দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপতি লুইস লাকাল পোউ’র গত পাঁচ বছরের শাসনকালে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও দেশে অপরাধ প্রবণতা মারাত্মক ভাবে বাড়তে দেখা গেছে। ছাঁটাই ও বেকারির পাশাপাশি, এই সময়কালে সাধারণ মানুষের আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে জরুরি জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। তার জেরে খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিনের সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতায় ব্যাপক হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে খড়া পরিস্থিতি, মন্দার আর সঙ্কটের সুযোগে বাড়তে থাকা মাদক পাচার, কালো বাজারি ও দুর্নীতিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। 
এই সমস্ত সমস্যার মোকাবিলা করতে সামাজিক পরিষেবাগুলি আরও সম্প্রসারিত করার ডাক দেন ওরসি ও ব্রড ফ্রন্ট। নয়া উদারবাদী ‘ব্যয় সঙ্কোচন নীতি’-র বিরোধিতা করেই সমর্থন বাড়িয়েছে ব্রড ফ্রন্ট। এর আগে প্রায় ১৫ বছর ধরে বামপন্থীদের ক্ষমতায় থাকার দরুণ উরুগুয়ের নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তি অংশের মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা এক অন্য মাত্রায় পৌঁছায়। গত ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ‘পেপে’ মুজিকার শাসনকাল উরুগুয়ের বামপন্থী চেতনা বৃদ্ধি ও কল্যাণকর রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ব্রড ফ্রন্টের শাসনকালে, লাতিন আমেরিকায় মধ্যে সর্বপ্রথম এদেশেই গর্ভপাত ও সমলৈঙ্গিক বিবাহকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। 
‘সাম্য, ঐক্য ও স্বাধিনতা’ রক্ষার নির্বাচনী লড়াইয়ে বামপন্থীদের মূল ভিত্তি ছিল অসংগঠিত শ্রমিক, খুচরো ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত ও বিভিন্ন প্রান্তিক অংশের মানুষ। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, নানা রকম কল্যাণকর নীতির মাধ্যমে মন্দা পরিস্থিতির নিষ্পত্তি এবং মাদক পাচার সংক্রান্ত অপরাধ মূলক কার্যকলাপ দমনের মতো প্রতিশ্রুতিকেই সামনে রেখে লড়েন ওরসি। দক্ষিণপন্থীদের শাসনকালে নয়া-উদারবাদী নীতির শিকার হয়ে, সমাজের যেই সমস্ত অংশ আরও বেশি করে কোণঠাসা হয়েছেন, চলতি পরিস্থিতির হাল ফেরাতে তারাই বামপন্থীদের ভরসা করে ভোট দিয়েছেন।
জয়ের পর এক বক্তৃতায় মুজিকার শুরু করা বিভিন্ন সমাজকল্যাণ মূলক প্রকল্প ও পরিষেবার সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওরসি। সমাজের প্রান্তিক অংশের মানুষের কাছে সেই সমস্ত সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্ত আকারে পৌঁছানোই হবে তার সরকারের লক্ষ্য। পাশাপাশি মজুরি বৈষম্য খতম করা ও কর্মসংস্থানে বৃদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওরসি। সামাজিক বিভাজন কমিয়ে, দেশে সম্প্রীতির বাতাবরণ আরও বিকশিত করার ডাক দিয়ে রবিবার গভীর রাতে এক বক্তৃতায় ওরসি বলেন,‘‘রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি সমাজ এবং দেশে সমন্বয়ের বার্তা দিতে চাই। এই দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে কেউ যাতে পিছিয়ে না পড়ে, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।’’ এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে, দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাকেই মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছেন ওরসি। 
প্রসঙ্গত নব-নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়ামান্ডু ওরসির রাজনৈতিক জীবন শুরু উরুগুয়ের কিংবদন্তী বামপন্থী রাষ্ট্রপতি এবং প্রাক্তন গেরিলা জোসে মুজিকার ছাত্র হিসেবে। ওরসির নির্বাচনী প্রচারেও মুজিকা অংশগ্রহণ করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বছর ৫৭-র ওরসি প্রথম জীবনে ছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক। পরে এদেশের কানেলোনেস প্রদেশের মেয়র হিসেবেও তিনি নির্বাচিত হন।   
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছাড়াও উরুগুয়ের সংসদের দুটি কক্ষ, সেনেট ও ‘চেম্বার অব রিপ্রেজেন্টেটিভস’ এই মরশুমে ছিল ভোটগ্রহণ। সেনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মিললেও, ‘চেম্বার অব রিপ্রেজেন্টেটিভস’-এ ব্রড ফ্রন্ট সংখ্যালঘু অবস্থানে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যে কোন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে, সংকীর্ণতাকে বিসর্জন দিয়ে ‘অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি’-র ভিত্তিতে বামপন্থীদের সমঝোতা ও জোট নির্মাণের পথকে বেছে নিতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশ। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের উর্ধ্বে গিয়ে ওরসি সেই পথই অবলম্বন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অনেকে মনে করছেন, উরুগুয়ের ইতিহাসে এই ধারার রাজনৈতিক অধ্যয়ন একেবারেই নতুন।
 

Comments :0

Login to leave a comment