কোনও চাপ, কোনও দাবিকেই পাত্তা দিতে নারাজ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কমিটি নিযুক্ত নির্বাচন কমিশন। বৃহস্পতিবার বিকালে যখন ষষ্ঠ দফার প্রচার শেষ হলো, তার কিছু পরেই কমিশন পঞ্চম দফায় মোট কত ভোট পড়েছে তার ফের একটা আনুমানিক হিসাব দিয়েছে কমিশন। একই সঙ্গে কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, ফল প্রকাশের পরই ভোটের চূড়ান্ত হার জানানো হবে। তার আগে নয়।
সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রশ্ন তুলেছে, কেন কমিশন ভোটের হার জানাতে এত দেরি করছে? কেন নির্বাচন কমিশন কোন বুথে কত ভোট পড়েছে, সেই তথ্য বা ফর্ম নিজেদের ওয়েবসাইটে তুলে দিচ্ছে না? কমিশন সে ব্যাপারে হলফনামা দিয়ে দাবি করেছে, সেই হিসাব জানালে নাকি ‘গন্ডগোল’ বেধে যাবে। তাই কোনওভাবে বুথভিত্তিক হিসাব জানাবে না কমিশন। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টে এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি হওয়ার কথা। তার আগে বৃহস্পতিবার এই মামলার আইনজীবী কপিল সিবাল সাংবাদিক সম্মেলন করে আবারও সরব হয়েছেন ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’ তত্ত্বে। বুথভিত্তিক ভোটের হার জানানো নিয়ে কমিশনের অবস্থান ‘বেশ সন্দেহজনক’ বলে মন্তব্য করে বর্ষীয়াণ আইনজীবী বলেন, তিনি অবাক কেন কমিশন এই তথ্য জানাতে চাইছে না।
চলতি লোকসভা নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটের পর থেকেই নির্বাচন কমিশনের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কমিশন প্রাথমিক ভাবে যে ভোটের হার বলেছিল, তিন-চার দিন পরে তার থেকে ৫-৬ শতাংশ বেশি ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছিল। প্রথম দফার ভোটের ১১ দিন পরে কমিশন চূড়ান্ত ভোটের হার জানিয়েছিল। গত সোমবার পঞ্চম দফার ভোটগ্রহণের চূড়ান্ত হিসেব কমিশন এখনও দেয়নি। মোট কত ভোট পড়েছে, সেই সংখ্যাও কমিশন জানাচ্ছে না। চারদিন পর বৃহস্পতিবার একটা আনুমানিক হিসাব দিয়ে কমিশন জানিয়েছে, পঞ্চম দফায় ভোট পড়েছে ৬২.২০ শতাংশ। পুরুষের তুলনায় মহিলারা বেশি ভোট দিয়েছে। এসব জানালেও কোন বুথে কত ভোট পড়েছে, যথারীতি তা জানায়নি কমিশন। কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, ফল ঘোষণার পরই চূড়ান্ত ভোটের হার জানানো হবে। কমিশনের যুক্তি, পোস্টাল ব্যালট গোনা হলে তবেই মোট ভোটের হার হিসাব করা যাবে।
ভোটগ্রহণের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভোটদানের বুথভিত্তিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে, এমনই আবেদন নিয়ে সু্প্রিম কোর্টে দ্বারস্থ হয়েছে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রাইটস্ (এডিআর)। সেই মামলায় বুধবার নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে, ভোটগ্রহণের রেকর্ড বা ১৭সি ফর্ম কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া হলে তা নিয়ে কারচুপি হতে পারে। সেই ফর্মের ছবি বিকৃত করে অবিশ্বাস তৈরির চেষ্টা হতে পারে। কমিশনের বক্তব্য, ওইফর্ম শুধুমাত্র পোলিং এজেন্টদের দেওয়া হয়। তা জনসমক্ষে আনার নিয়ম নেই।
ভোটের হারে এই অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে কংগ্রেস আজ বলল, লোকসভা ভোটের প্রথম চার দফায় ভোটগ্রহণের পরে নির্বাচন কমিশন প্রাথমিকভাবে যে ভোট পড়েছিল বলে জানিয়েছিল, আর পরে যা জানিয়েছে, তার মধ্যে ১ কোটি ৭ লক্ষ ভোটের ফারাক। অভিযোগ, এর ফলে প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রে গড়ে প্রায় ২৮ হাজার ভোটের ফারাক হয়ে যাচ্ছে।
বুধবার কংগ্রেসের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ এই গরমিলের হিসাব তুলে ধরে বলেন, ‘এটা বিরাট অসঙ্গতি। যে সব রাজ্যে বিজেপি’র আসন হারানোর সম্ভাবনা বেশি, সেখানে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত ভোটের হারের মধ্যে অসঙ্গতিও বেশি। হচ্ছেটা কী? কংগ্রেসের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান পবন খেরা বলেন, ‘ভোটাররা চিন্তিত। প্রথমে ১০-১১ দিন পরে কমিশন ভোটের চূড়ান্ত হার বলছে। তার পরে দেখা যাচ্ছে, চার দফায় ১ কোটি ৭ লক্ষ ভোটের ফারাক হয়ে গিয়েছে। হারিয়ে যাওয়া ইভিএম নিয়ে প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তাও চিন্তার।’
কমিশন সূত্রের বক্তব্য, সব জায়গায় প্রাথমিক ও চূড়ান্ত হিসাবে ভোটের হারে ফারাক হচ্ছে না। মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভোটের চূড়ান্ত হিসাব দেরিতে আসছে। তা ছাড়া গরমের জন্য অনেকে শেষ বেলায় এসে ভোটের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। নির্ধারিত সময়ের পরেও ভোটগ্রহণ চলছে। এমন গরমে তো আগেও ভোট হয়েছে, এমনকি এখনকার মতো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল না, তা সত্ত্বেও আগে পরদিনই জানানো হতো চূড়ান্ত হার। কিন্তু সেই হিসাব কষতে ১০-১১ দিন কেন লেগে যাচ্ছে, তার কোনও উত্তর অবশ্য দেয়নি কমিশন।
এদিন সে প্রসঙ্গেই সাংবাদিক সম্মেলনে আইনজীবী কপিল সিবাল বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলি তো কমিশনের ভূমিকা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করছে। বর্ষীয়ান আইনজীবীর কথায়, ‘১৭সি ফর্মের তথ্য ওয়েবসাইটে তুলে দিলে সমস্যা কোথায়? কমিশনের এনিয়ে এত কীসের দ্বিধা? কী হবে যদি বাস্তবে যা ভোট পড়েছে, তার বেশি ভোট গোনা হয়? আমরা তো জানিই না কোনটা ঠিক বা কোনটা নয়! ওয়েবসাইটে স্ক্যান করা ১৭সি ফর্ম তুলে দিতে কমিশনের কীসের এত আপত্তি? কেউ এনিয়ে জালিয়াতি করতে পারবে না। পোলিং এজেন্টের কাছে থাকা সেই ফর্মের প্রতিলিপির সঙ্গে সহজেই তো মোট ভোটের হিসাব মিলিয়ে নেওয়া যাবে।’
Comments :0