Editorial

ন্যাকা কান্না

সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial


কিছুদিন আগেও যিনি ‘রেবড়ি সংস্কৃতি’র (দান-খয়রাতি) বিরুদ্ধে মুখর ছিলেন সেই তিনিই এখন রেবড়ি সংস্কৃতির ঘোরতর অনুগামী বিপদে পড়লে এমনই হয়ে থাকে। ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারি ব্যবস্থা থেকে ভরতুকির যাবতীয় প্রকল্পগুলি চিরতরে তুলে দেবার পক্ষে জোরালো সওয়াল করে গেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পূর্বতন কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী সরকারগুলির চালু করা সাধারণ মানুষের স্বার্থে ভরতুকি দেওয়া প্রকল্পগুলি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-মশকরাও কম করেননি। নয়া উদারনীতির ব্যবস্থায় বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে বাজারকে সম্পূর্ণরূপে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার তত্ত্বে বিশ্বাস করেন মোদী। সরকারের তরফে ভরতুকি দিয়ে জনসাধারণের কাছে কম দামে পণ্য-পরিষেবা দেবার ঘোরতর বিরোধী তিনি। কোনও মতেই তিনি চান না সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ করে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মুনাফায় ব্যাঘাত ঘটাক। বাজারে মুনাফাখোরদেরই অবাধ রাজত্ব চান তিনি। তাই গণবণ্টন ব্যবস্থাকে ছাঁটতে ছাঁটতে তলানিতে আনার চেষ্টা করেছেন। জ্বালানি তথা পেট্রোপণ্য থেকে ভরতুকি তুলে দি‍‌য়েছেন। এমনকি তুলে দেবার পাশাপাশি দফায় দফায় নানাবিধ কর, সেস, সারচার্জ বসিয়ে জনগণের পকেট কেটে সরকারের কোষাগার ভরিয়েছেন। সেই প্রধানমন্ত্রী আজ ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কে নিজের ফেলা থুতু চেটে রান্নার গ্যাসের দাম কমানোর কথা গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করেছেন। রাখি বন্ধন উপলক্ষে দেশের বোনেদের জন্য নাকি এটা তাঁর উপহার। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে মা-বো‍‌নের যন্ত্রণার কথা নাকি তিনি বোঝেন। তাই সেই যন্ত্রণা লাঘব করতে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ২০০ টাকা কমিয়ে উপহার দিয়েছেন।
বস্তুত ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই রান্নার গ্যাস-সহ সমস্ত পেট্রোপণ্য থেকে সরকারি ভরতুকি ধাপে ধাপে প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করেন নরেন্দ্র মোদী। কথার খেলাপ করেননি। প্রথমে ভরতুকি উঠে যায় পেট্রোল থেকে। তারপর ডিজেল থেকে। আরও পরে কেরোসিন থেকে। সর্বশেষ ২০২০ সালের জুন মাসে রান্নার গ্যাস থেকেও ভরতুকি তুলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি জানিয়ে দেওয়া হয় অশোধিত তেলের মূল্য ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক মূল্য ধরে নির্ধারিত হবে পেট্রোপণ্যের বিক্রয় মূল্য। সেটা করবে তেল বিপণন সংস্থাগুলি। তেমনি বাজার অনুযায়ী প্রতিদিন বা পনেরদিন অন্তর বদলানো হবে মূল্য। বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দামের ওঠানামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও তেল-গ্যাসের দাম বাড়বে কমবে। কিন্তু বাস্তবে গত সাড়ে নয় বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে বিশ্ব বাজারের দাম বা‍‌ড়লে দেশে দাম বাড়ে কিন্তু বিশ্ব বাজারে কমলে দেশে কমে না। দাম কমার সেই সুবিধাটুকু জনগণকে না দিয়ে মোদী সরকার কর, সেস, সারচার্জ বাড়িয়ে সরকারের কোষাগারে নিয়ে যায়। এইভাবে গত দশ বছরে ৫০০ টাকার সিলিন্ডা‍‌রের দাম বাড়তে বাড়তে ১১০০ টাকা ছা‍‌‍ড়িয়ে গেছে। এমন সামনে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন এবং তার কয়েক মাস পরে লোকসভা নির্বাচন এসে যাওয়ায় ঘোর বিপদের আশঙ্কায় এক ধাক্কায় ২০০ টাকা দাম কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্যাসসহ যাবতীয় পণ্যের উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় সাধারণ মানুষ যেভাবে তিতিবিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন তার হাতে গরম উদাহরণ কর্ণাটক। মোদীদের সরকারকে গোহারা হারিয়ে সেখানে কংগ্রেস ক্ষমতা দখল করেছে। মধ্যপ্রদেশেও ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা প্রবল। এই অবস্থায় আগামী বছর মোদী নিজে ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন কিনা অনিশ্চিত হ‍‌য়ে পড়েছে। অতএব রেবড়ি সংস্কৃতির হাত ধরে মন গলাতে ন্যাকা কান্নার নাটক শুরু করে দিয়েছেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment