Editorial

ফাঁকা কলসির শব্দ বেশি

সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial


ন’বছর পার করে দশ বছরে পা দিয়েছে কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি সরকার। এক বছরের পরেই হবে লোকসভা নির্বাচন। তাই এই নবম বর্ষপূর্তি ও দশম বর্ষে পদার্পণ মোদী সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনুমান করা গিয়েছিল মোদী জমানার দীর্ঘ নয় বছরের সাফল্যের ফিরিস্তি নিয়ে প্রচারের ঝড় তোলা হবে এবং তাকে নির্বাচনী প্রচারে রূপ দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে আগামী লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত। বাস্তবে তেমনটা হয়নি। দশম বর্ষে পদার্পণটা অনেকটা ম্যাড়ম্যাড়েভাবে কেটেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অবশ্য দার্শনিক গাম্ভীর্য নিয়ে বলেছেন এই ৯ বছরে যা কিছু করেছেন তা সাধারণ মানুষের হিতের কথা মাথায় রেখেই করেছেন। অর্থাৎ তাঁর ধ্যানজ্ঞান সবটাই সাধারণ মানুষের ভাল করাকেই ঘিরে। অবশ্য সাধারণ মানুষের ঠিক কোন্‌ কোন্‌ ভালোটা তিনি করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন অথবা করার কথা ভেবেছেন তা খোলসা করেছেন। তাছাড়া এই নয় বছরে ঢাকঢোল পিটিয়ে যে সব বহুল প্রচারিত প্রকল্পের ধ্বজা উড়িয়েছেন তার বেশির ভাগই সাধারণ মানুষের কাজে আসেনি।


ধরা যাক কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা। ২০১৪ সালে তাঁর ভোট প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি। ন’বছরে সরকারের সবচেয়ে ব্যর্থতা এই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। বেকার ছেলে-মেয়েদের কাজ দিতে পারেননি, ফলে স্বাধীন ভারতে সর্বকালের সর্বোচ্চ বেকারি বৃদ্ধি ঘটেছে তাঁর আমলেই। যে রেগা প্রকল্প যা গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সবচেয়ে কার্যকরী সেটা একদা ছিল নরেন্দ্র মোদীর কাছে সরকারি অর্থ নষ্ট করে গর্ত খোঁড়ার কাজ। গত নয় বছরে গ্রামের কর্মহীন গরিব মানুষকে কাজ দেবার বিকল্প কোন প্রকল্প মোদী সরকার চালু করতে পারেনি। তাঁকে নির্ভর করতে হয়েছে পূর্বতন সরকারের উদ্ভাবিত প্রকল্পের উপরই। রেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে সরকারি ব্যয় বাঁচিয়েছেন ঠিকই তাতে গ্রামের গরিব মানুষের দু’র্দশাই বেড়েছে। আর করোনা মহামারীর সময় রেগা প্রকল্প ছিল বলেই গ্রামের গরিব মানুষ কোনো রকমে এক মুঠো খে‍‌য়ে বাঁচতে পেরেছেন।


নরেন্দ্র মোদীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেওয়া একটা ফ্যাশান। বাস্তবে যথার্থ অর্থে কাজ তৈরি হবে, অনেক বেশি বেশি ছেলে-মেয়ে কাজের সুযোগ পাবে তেমন কোনও প্রকল্পের কাজ মোদী সরকার চালু করতে পারেনি। তথাকথিত উন্নয়নের নামে মোদী সরকারের প্রকল্পগুলি আসলে বেসরকারি কর্পোরেটে মুনাফা বৃদ্ধি এবং গুটিকতক ব্যক্তির সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যেই নিয়োজিত। উদারনীতির আধারের সংস্কারের যে ঢালাই পদক্ষেপ এই সরকার নিয়েছে তাতে সংখ্যা তত্ত্বে বৃদ্ধি দেখানো গেলেও সুফল যা কিছু ঘরে তোলে বিত্তবানরা। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ভাগে কিছুই জোটে না। তাই মোদী জমানায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যেটুকু হয়েছে সাধারণ মানুষ তার ভাগ পাননি। অর্থাৎ মোদীর উন্নয়নের অন্তর্নিহিত সত্য হলো দৃষ্টিকটুভাবে এবং উদ্বেগজনকভাবে আয় ও সম্পদ বৈষম্য বৃদ্ধি। মোদীরা কথায় কথায় গর্ব করেন এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ হারে বৃদ্ধির অর্থনীতি ভারত। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও এটা উচ্চারণ করেন না গত দশকে বিশ্বের বৈষম্যের দেশ হয়ে উঠেছে ভারত। মানুষের শ্রম ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় যে সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে তা সাধারণ মানুষ পাননি, সবটাই চলে গেছে কোটি পতি, শতকোটিপতিদের ঘরে।


মোদী জমানার ন’বছর ও আগের ন’বছরের মধ্যে তুলনা করলে কোনও ক্ষেত্রেই মোদীদের দাবি ধোপে টিকবে না। আগের ৯ বছরে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মোদী জমানার বৃদ্ধি মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে মোদী জমানায় অনেকটাই বেশি। আগের জমানায় রান্নার গ্যাসের দাম ৪০০ টাকা হবার পর রাস্তায় নেমেছিলেন মোদীরা। এখন সেই গ্যাস ১২০০ টাকা ছুঁইছুঁই। নির্লজ্জের মতো সাফাই গাইছে সরকার। বিনামূল্যে গরিব পরিবারের গ্যাস কানেকশন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিলিন্ডার কেনার আয় তাদের নেই। ২০১৬ সালের নির্বোধের মতো আচমকা নোট বাতিল করে এবং জিএসটি চালু করে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। তার ধাক্কায় লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র সংস্থা ও ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন কাজ পাওয়ার বদলে মানুষ কাজ হারিয়েছেন। হিসাব করলে দেখা যাবে ৯ বছরে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ খুব একটা বাড়েনি। আগের ৯ বছরে বেড়েছিল এর থেকে অনেক বেশি। ঘোষণা করেছিলেন ২০২২ সালের মধ্যে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হবে ভারত। পরে গোল পোস্ট সরিয়ে ২০২৪ সাল করা হয়। বর্তমানে খুঁড়িয়ে খুঁ‍ড়িয়ে ৩.৩ লক্ষ কোটি ডলার হয়েছে। ৫ লক্ষ কোটি হতে আরও কত বছর লাগবে কে জানে।


 

Comments :0

Login to leave a comment