প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে গঠিত এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত নীতি আয়োগকে পূর্বতন যোজনা কমিশনের আধুনিক ও যুগোপযোগী সংস্করণ বলে একদা প্রচার করা হলেও সেটা যে আদৌ তা নয় বরং তার ঠিক উলটো যত দিন যাচ্ছে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নীতি আয়োগ আসলে নয়া উদারনীতির মেধা ভাণ্ডার। ভারতের মাটিতে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে নয়া উদারনীতির দ্রুত ও ব্যাপক প্রয়োগের পরিকল্পনা তৈরি করাই নীতি আয়োগের কাজ। এই ধরণের পরিকল্পনা তৈরি করে তারা সরকারের কাছে সুপারিশ আকারে পেশ করে। পরবর্তীতে সরকার ধাপে ধাপে তা রূপায়ণ করে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত নীতি আয়োগ সরকারের কাছে যত সুপারিশ পাঠিয়েছে তার সবগুলিই উদারনীতির শর্ত মেনে কর্পোরেট স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে।
প্রতি ক্ষেত্রে কর্পোরেট স্বার্থকেই ঘুরিয়ে দেশে স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থ বলে চিহ্নিত করেছে। সরকার সরাসরি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কর্পোরেটের পক্ষে গেলে সমালোচনার মুখে পড়ে রাজনৈতিক জমি শিথিল হতে পারে। তাই তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সুপারিশ তৈরি করিয়ে তা গ্রহণ করে মানুষের চোখে ধুলো দিতে চায়। ব্যাপারটা এমন সরকার নিজে থেকে কিছু করছে না দেশের অগ্রগতির স্বার্থে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো মোদী সরকারের নীতির সঙ্গে পূর্ণ সহমত পোষণ করে এমন ব্যক্তিরাই নীতি আয়োগের সদস্য হতে পারেন। সরকারের নীতির বিকল্প ভাবনা যাদের আছে তাদের ঠাঁই নীতি আয়োগে হয় না। তাই নীতি আয়োগে যারা বসে আছেন তারা সরকারেরই প্রতিনিধি। সরকারের ভাবনাকেই তারা প্রস্তাবাকারে সরকারের কাছে পাঠায়। তাই নীতি আয়োগ কোনোদিন সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পের জন্য সুপারিশ করে না। উদারনীতির সূত্র মেনে তারা অর্থনীতিতে সরকারে সরাসরি অংশগ্রহণ বা নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। সরকার শিল্প বাণিজ্য চালাক, ব্যাঙ্ক বিমা চালাক নীতি আয়োগ চায় না। তাই সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ধাপে ধাপে বেসরকারি হাতে তুলে দেবার পক্ষে। এমন কি রেল পরিবহণও বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চায়। তাদের পরামর্শেই একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান পরিবহণ সংস্থা এয়ারইন্ডিয়া বিক্রি হয়ে গেছে। নীতি আয়োগ চায় দেশের যাবতীয় খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হোক। দেশের জনগণের সম্পদ লুটেপুটে খাক কর্পোরেট।
নীতি আয়োগ চায় দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া হোক বেসরকারি তথা মুষ্টিমেয় কর্পোরেটের হাতে। তাদের সবদিক থেকে অবাধ ছাড় দেওয়া হোক যাতে বাণিজ্যে তাদের ব্যয় সর্বনিম্ন হয় এবং মুনাফা সর্বোচচ হয়। কর্পোরেট ও বিত্তবাণদের কাছ থেকে যতটা সম্ভব কম কর আদায় করা হোক। তাতে তাদের হাতে মুনাফার পরিমাণ বাড়বে। বেশি মুনাফা করলে তারা নাকি বেশি বিনিয়োগ করবে। তখন শিল্পের বিকাশ হবে। অর্থনীতি জোরদার হবে। বিপুল কর্মসংস্থান হবে। দেশ থেকে বেকারি নির্মূল হয়ে যাবে।
গত সাত আট বছরে নীতি আয়োগের সুপারিশে কর্পোরেটের জন্য সুযোগের দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে। তাদের দেশের সম্পদ ও মানুষের শ্রম দেদার লুটে তাদের সম্পদের পাহাড় তৈরি হচ্ছে। আয় ও সম্পদ বৈষম্য হু হু করে বেড়েছে। বেকারি বেড়েছে। আয় কমেছে। তাই দেশের মোট সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশের মালিক দেশের ৫০ ভাগ মানুষ। হাতে গোনা কয়েকজন ধনপতি কুক্ষিগত করেছে দেশের মোট সম্পদের অর্ধেক। দেশের বিকাশ ও জনগণের উন্নতির নাম করে নীতি আয়োগের পরামর্শে মোদী সরকার কর্পোরেট বিত্তবানদের সেবা করে যাচ্ছে।
Comments :0