Editorial population census

জনগণনা হচ্ছে না কেন?

সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial population census


আধুনিক রাষ্ট্রে জনগণনা একটি অতি অত্যাবশ্যকীয় সরকারি কাজ। বিশ্বের ছোট-বড়, উন্নত-অনুন্নত সব দেশেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণনা হয়ে থাকে। সব দেশেই সাধারণভাবে প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনা হয়। পরাধীন ভারতে সেই ১৮৭২ সালে শুরু হয় গণনার কাজ। প্রতি দশ বছর অন্তর ২০১১ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে তা হয়ে আসছে। 

এমনকি দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধেও ভারতের জনগণনার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পা‍‌রেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম মোদী জমানায় ২০২১ সাল। কোভিড মহামারীর দোহাই দিয়ে জনগণনার কাজ সেই যে বন্ধ করে রাখা হয়েছে তারপর থেকে সরকারের মুখে কোনও রা নেই। অদ্ভুত এক নিষ্পৃহতার মধ্যে দিয়ে দেশের সামগ্রিক স্বার্থের পক্ষে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ফেলে রাখা হয়েছে।


জনগণনা একটি বিপুল কর্মযজ্ঞ। দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবস্থিত প্রতিটি বসতবাড়িতে ‍‌গিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এটা নিছক দেশের লোকসংখ্যা গোনা নয়, একই সঙ্গে পারিবারিক ও  ব্যক্তিগত স্তরে অজস্র তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যেমন কত পরিবার আছে, বাড়ির অবস্থা কেমন, পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে কিনা, বিদ্যুৎ সংযোগ আছে কিনা, শৌচাগার আ‍‌ছে কিনা ইত্যাদি। পরিবারের সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা, পেশা, রুজির পরিমাণ, ধর্ম, জাতি/উপজাতি ইত্যাদি তথ্যও সংগ্রহ করা হয়। জনগণনার মাধ্যমে দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা সংক্রান্ত বিপুল তথ্য ভাণ্ডার উঠে আসে সরকারের হাতে। এই তথ্যই সরকারে যাবতীয় পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণের প্রধান ভিত্তি। এই তথ্য হাতে না থাকলে কিছু মনগড়া ধারণার  উপর ভিত্তি করে বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য বা স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতে পারে। দেশের এবং দেশের মানুষের  প্রকৃত অবস্থা জানা না থাকলে কোনও সরকারের পক্ষেই সকল নাগরিকের স্বার্থে উন্নয়ন পরিকল্পনা রূপায়ণ করা সম্ভব নয়।


কোভিড মহামারীর কারণে জনগণনার কাজ বন্ধ আ‍‌ছে বলে সরকারের তরফে জানানো হ‍‌লেও সরকারি এই ভাষ্য নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। গণনার মূল কাজ ২০২১ সালে শুরু হবার কথা থাকলেও প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজ অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। এবার তেমন কোনও  তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। তেমনি ২০২২ সালের শেষ দিকে করোনার প্রভাব ক‍‌মে গেলেও গণনার কাজ শুরু হয়নি  বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা  ছাড়াই। এমনকি এখনও স্পষ্ট নয় কবে থেকে এই কাজ শুরু করা হবে।  তবে নানা মহল থেকে যে অনুমান বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে তা হলো ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে জনগণনা শুরু করবে না মোদী সরকার।


কোভিডের জন্য বছর দেড়েক কাজ আটকে থাকতে পারে বড়‍‌জোর, অনন্তকাল  বন্ধ থাকতে পারে না। কোভিড মহামারীর মধ্যে ১২টি রাজ্য সহ পুদুচেরি, দিল্লিতে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এই নির্বাচনগুলিতে অংশ নিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন মিছিল-সভায় যোগ দিয়ে‍ছেন। ট্রেনে বাসে ভিড়ে যাতায়াত করেছেন। জনগণনায় একজন-দু’জন কর্মী পায়ে হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করেন। অতএব করোনার জন্য জনগণনা বন্ধ  এই যুক্তি ধোপে টেকেনি। তাছাড়া এই সময়কালে ‍‌বিশ্বের  বেশিরভাগ দেশ তাদের জনগণনার কাজ সেরে ফেলেছেন। প্রতিবেশী নেপাল, বাংলাদেশেও সাফল্যের সঙ্গে জনগণনা করেছে। বিশ্বের ৮টি জনবহুল দেশের মধ্যে ভারত ছাড়া সকলেরই জনগনণা হয়ে গেছে। গণনা হয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, ব্রাজিলেও।


তাহলে ভারতে গণনা বন্ধ  থাকছে কেন? আসলে ২০২৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে অপ্রিয় সত্য ও তথ্যের  মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছে সরকার। মোদীর ঘোষিত সাফল্য সকলের পাকাবাড়ি, সব বাড়িতে বিদ্যুৎ, শৌচাগার, পানীয় জল রান্নার গ্যাসের ধাপ্পা ফাঁস হয়ে যেতে পারে প্রকৃত তথ্য হাতে এলে। তেমনি খাদ্য নিরাপত্তা আইনের আওতায় বর্তমান ৮১ কোটি মানুষের বদলে ৯২ কোটি হতে পারে জনগণনা হলে। ২০১১ সালের তথ্য ব্যবহার করে সরকার খরচ কমাচ্ছে, দায় এড়াচ্ছে, কোটি কোটি মানুষকে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করছে।

Comments :0

Login to leave a comment