মধুসূদন চ্যাটার্জি - বাঁকুড়া
যেখানে বড়জোড়া, বেলিয়াতোড় এলাকার জঙ্গলে অবস্থান করা ৬টি হাতিকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বনবিভাগ, সেখানে কয়েকদিনের মধ্যেই ফের প্রায় ৯০টি হাতি রুটিন মতো দলমা থেকে বাঁকুড়া জেলায় প্রবেশ করবে। তখন পরিস্থিতি কোন ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছাবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। মৃত্যু আর ফসল, বসতবাড়ি ধ্বংস হওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকবে। যা গত কয়েক বছর ধরে ঘটছে। বাঁকুড়া জেলার বড়জোড়া, সোনামুখী, বেলিয়াতোড়, গঙ্গাজলঘাটি জঙ্গল সংশ্লিষ্ট এলাকার গ্রামগুলিতে এখন এটাই স্বাভাবিক। হাতির হামলায় মানুষের তাজা রক্তের স্রোত আর স্বজনহারার কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে বড়জোড়া, বেলিয়াতোড় এলাকায়। সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক সংগঠন, কৃষকসভা বারে বারে এই ভয়াবহ বিষয়টি উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে গত এক দশকে বিভিন্ন বনমন্ত্রী, বনদপ্তরের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানালেও কোন কাজ হচ্ছেনা। মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, ফসল ধবংস হচ্ছে কৃষকের। গরীব মানুষ হাতির হামলার ভয়ে কাজে যেতে পারছেন না। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া। বড়জোড়া এলাকার হাজারো মানুষের বক্তব্য পঞ্চায়েত, বনদপ্তরকে বলে বলে আমাদের মুখ ভোঁতা হয়ে গেছে। কিছুই করবে না ওরা। খালি আসন্ন মৃত্যুর প্রতীক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই নেই। কারণ নিরব বনদপ্তর। তাঁদের নাকি কিছুই করার নেই। তাদের বক্তব্য তাহলে বনদপ্তর আছে কেন? কেন হাতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ দেখানো হচ্ছে? কেন নিয়ম করে প্রতিবছর বেলিয়াতোড় ফরেষ্ট বাংলোতে বনমন্ত্রী, দপ্তরের রাজ্য ও জেলাস্তরের একডজন আধিকারিক, পুলিশ আধিকারিকরা হাতি নিয়ন্ত্রণের সভা করেন? সভায় যা ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা কি পালন করা হয়? পরের বার সভায় কি বিষয়গুলির কার্যকরী চিত্র তুলে ধরা হয়? জানতে চান বড়জোড়ার প্রাক্তন বিধায়ক সুজিত চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘বছরের পর বছর হাতির হামলায় মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। কোটি টাকার ফসল নষ্ট হচ্ছে। গরীবের ঘর চলে যাচ্ছে হাতির পায়ের তলায়। কতদিন এভাবে নিশ্চিত আতঙ্কের মধ্যে মানুষ দিন কাটাবেন?’’
ঘটনা হল আগেও হাতির পাল আসত বাঁকুড়ায়। দলমা থেকে আগস্ট মাসে এই পাল বিষ্ণুপুরের বাসুদেবপুর রেঞ্জে কয়েকদিন থেকে নদী পেরিয়ে পাত্রসায়ের, সোনামুখী হয়ে বড়জোড়া বেলিয়াতোড়ে এসে ডেরা নিত। সেই হাতির পালকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বনদপ্তরের কর্মীরা স্থানীয় পঞ্চায়েতকে সঙ্গে টিম তৈরী করতো। স্থানীয় মানুষজনকে নিয়ে তৈরী করা হতো হুলা পার্টি। এখন সে সব বন্ধ হয়ে গেছে।
বনদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক সুনীল বাসুলি জানান, ‘‘গত ১৩বছর ধরে বনদপ্তরে কোন নিয়োগ নেই। বনদপ্তরে লোক তলানীতে গিয়ে পৌঁছেছে। বহু রেঞ্জে কোন রেঞ্জার নেই, একই অবস্থা বিট গুলিতেও। একটা বিটে তিন চারজন কর্মী নিয়ে কি করে পুরো জঙ্গল নজর রাখবে? সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় স্তরের লোকজনকে বাদ দিয়ে বাইরে থেকে বিনা প্রশিক্ষনের লোকজনকে দৈনিক সামান্য মজুরির বিনিময়ে বড়জোড়া, সোনামুখী, বেলিয়াতোড়ের জঙ্গলে হাতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তাঁরা এলাকায় পরিচিত নন। ভৌগলিক অবস্থান তাঁদের জানা নেই। এর ফলে সোনামুখীতে সেই হুলাপার্টিরই একজন মারা যায় গতবছর। স্থানীয় মানুষজনকে যে তেল, মশাল, টর্চ দেওয়ার কথা তা দেওয়া হয়না সব সময়। কি করে তাঁরা হাতি নিয়ন্ত্রণ করবেন? তাই সন্ধ্যা হলেই আতঙ্কে ভুগছেন মানুষজন। কবে, কোথায়, কাকে, কখন মৃত্যুর মুখে পড়ে টাটকা লাসে পরিণত হতে হয়, বা আস্থানা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।’’
বর্তমানে বড়জোড়া, সাহারজোড়া , পাবয়া এলাকায় ৬টি আবাসিক হাতি রয়েছে। তারাই এখন খাবারের সন্ধানে সন্ধ্যা হলেই বের হচ্ছে। বনদপ্তরের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। মরছে মানুষ, ভাঙছে ঘর। কতদিন এটা চলবে?
Comments :0