অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
চার্লস ডারউইনের জৈব বিবর্তনবাদের তত্ত্ব (থিওরি অব বায়োলজিক্যাল ইভোলিউশন) বাদ পড়ায় দেশ জুড়ে উঠেছে এখন সমালোচনার ঝড়। জাতীয় স্তরে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) কেন্দ্রীয় বোর্ডের পাঠ্যক্রমকে নির্ণয় করে। তারাই এবারে দশম শ্রেণির জীবন বিজ্ঞানের বই থেকে এই বিষয়টি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর আগে করোনা মহামারীর সময় পড়ুয়াদের ওপর থেকে ‘সিলেবাসের বোঝা’ কমানোর যুক্তি দেখিয়ে বিবর্তনবাদকে সাময়িক সময়ের জন্য পাঠ্যক্রমের বাইরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই সিদ্ধান্তকে পাকাপাকি করে দেওয়া হল। এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করেছেন বিজ্ঞান সচেতন মানুষ থেকে বিজ্ঞানীরা।
দেশের ১৮০০ জনের বেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক খোলা চিঠি লিখে ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রাসঙ্গিকতা কেন্দ্র সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য ডারউইনের বিবর্তনবাদ বুঝতে শেখাটা যে অপরিহার্য তা পরিষ্কার বলা হয়েছে ওই খোলা চিঠিতে।
ভারতে স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যবই তৈরি হয় এনসিইআরটি’র সুপারিশ মেনে। ছাত্র-ছাত্রীদের বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে জানতে না-দেওয়াটা ‘শিক্ষার নামে প্রহসন’ বলেও মন্তব্য করেছেন ‘ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি’ নামে সর্বভারতীয় বিজ্ঞান সংগঠন। নবম-দশমে পর বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যান না যাঁরা, তাঁরাও বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সকলে।
এই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেন্দ্রকে লেখা চিঠি দিয়ে তা ফেরানোর দাবি জানিয়েছেন দেশের সব বড় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাকেন্দ্রের অধিকাংশ গবেষক। ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস এবং একাধিক আইআইটির মতো নামীদামী বহু প্রতিষ্ঠানের ১৮০০ বিজ্ঞানী। বিবর্তনবাদকে ফিরিয়ে আনতে পথে নেমেছে দেশের সবচেয়ে বড় জনবিজ্ঞান সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ।
আধুনিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের অন্যতম ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব। প্রাণীরা সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নিয়মে ধীরে ধীরে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে ওই তত্ত্বে। বিবর্তনবাদের এই তত্ত্বটি আমাদের পৃথিবীর পশুপাখি ও উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে বুঝতে বুঝতে সাহায্য করে। বদলানোর এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্রাকৃতিক নির্বাচন বা ন্যাচারাল সিলেকশন। এর মাধ্যমে একটি প্রাণীর জনগোষ্ঠী থেকে নতুন প্রজাতি জন্ম নেয়। সব দিক থেকেই তাই ওই থিওরি বিজ্ঞানের জগতে বৈপ্লবিক তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃত।
১৮৫৯ সালে ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’ বইয়ে চার্লস ডারউইন তাঁর তত্ত্বটির বিস্তারিত ব্যাখা দিয়েছেন। বইয়ে ডারউইন বিবর্তনবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে কোনো প্রাণী ক্রমাগত অভিযোজনের ফলে আপন পরিবেশের জন্যে বিশেষায়িত হতে হতে এক সময় নতুন একটি প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়। শিপাঞ্জি থেকে মানুষের উদবর্তন হওয়াটা যার মূল উপজীব্য বিষয়। কালের হাত ধরেই তা ঘটেছে। কোন অতিজাগতিকভাবে আজকের মানুষ পৃথিবীর বুকে আসেনি।
ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে বিশ্বের বহু দেশে আগে থেকেই বিতর্ক ছিলো। ধর্মীয় কারণে পৃথিবীর নানা দেশেই এটি স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে পড়ানো হয় না। ভারতের বিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে এটিকে বাইরে রাখার ঘটনা এই প্রথম। ভারতের মতো বিজ্ঞানে আগ্রহী দেশে এমনটা যে কোনদিন হতে পারে, তার ধারণা কারো ছিল না। তাই দেশের বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, যে অতি দক্ষিণপন্থী বিজেপি ভারতে ক্ষমতায় থাকায়, তাদের সমাজদর্শন ও ধ্যানধারণার স্তুতি করতেই এনসিইআরটি’র এই বাড়তি পদক্ষেপ।
মোদী সরকারের প্রথম দফার সরকারেই বিবর্তনবাদ নিয়ে তীব্র বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন তৎকালীন মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং। মুম্বাই পুলিশের এই সাবেক কমিশনার ২০১৮ সালে দেশের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন দাবি করেছিলেন, ডারউইনের তত্ত্ব বৈজ্ঞানিকভাবেই ‘ভুল’। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘কেউ কি কখনও দেখেছে একটা বাঁদর ধীরে ধীরে মানুষে পরিণত হচ্ছে ?’ ‘মানুষ যখন থেকে পৃথিবীতে এসেছে, তখন থেকেই সে মানুষই ছিল’ বলেও দাবি করেন তিনি।
এই মন্তব্য নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পরও সত্যপাল সিং নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি। বরং প্রশ্ন করেছিলেন, দেশের স্কুল-কলেজে অবিলম্বে বিবর্তনবাদ পড়ানো বন্ধ করা উচিত। সত্যপাল সিং এখন আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত নন, কিন্তু দেশের সরকার তার সেই বক্তব্যই বাস্তবায়ন করছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
কিন্তু ডারউইনের থিওরিকে যেভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে তাতে ভারতের বিজ্ঞানচর্চা তথা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। লেখক ও গবেষক দীনেশ চন্দ্র শর্মার কথায়, ‘আজ ডারউইনকে বাদ দিয়ে জীববিদ্যা পড়ানো হচ্ছে। এরপর হয়তো নিউটন আর আইনস্টাইনকে বাদ দিয়ে ফিজিক্স পড়ানোর চেষ্টা হবে।’
তবে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে দেশে দেশে সব সময়ই বিতর্ক ছিলো। ডারউইনের থিওরি অব ইভোলিউশন বা বিবর্তনবাদ নিয়ে নানা সময়ে বিতর্ক নতুন নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিগত বহু দশক ধরে আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায় ও রক্ষণশীল গোষ্ঠী চার্লস ডারউইনের এই তত্ত্ব নিয়ে আপত্তি জানিয়ে এসেছে। তবে সিলেবাস থেকেই এই থিওরি বাদ দেওয়ার মতো চরম পদক্ষেপ নিয়েছে হাতে- গোনা মাত্র কয়েকটি দেশ।
এদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায়। বিবর্তনবাদের এই তত্ত্ব সৌদি আরব, তুরস্ক, ওমান, আলজেরিয়া ও মরক্কোতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননেও তা পড়ানো হয় না। জর্ডনে এটি পড়ানো হয় ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে, আর মিশর ও তিউনিসিয়ার পাঠ্যবইয়ে এই বিবর্তনবাদকে তুলে ধরা হয়েছে ‘অপ্রমাণিত’ একটি প্রকল্প বা হাইপোথিসিস হিসেবে।
ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেই সিলেবাসে ডারউইনের থিওরি খারিজ করা হয়েছে বহুকাল ধরে। এবার ভারতের স্কুল ক্লাসরুমে আর পড়ানো বন্ধের পথে ডারউইনের বিবর্তনবাদ। ডারউইনের থিওরি নিয়ে বহু ইসলামিক ধর্মগুরু নানান সময়ে বিভিন্ন ফতোয়াও জারি করেছিলেন। আমেরিকাতে আবার বেশ কিছু ক্যাথলিক খ্রীষ্টান গোষ্ঠী বিবর্তনবাদের বিকল্প হিসেবে সৃষ্টিতত্ত্বের (ক্রিয়েশনিজম) পক্ষে সওয়াল করে থাকে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদও একই চিন্তার শরিক।
এই ‘ক্রিয়েশনিজম লবি’র প্রবক্তারা বলে থাকেন মানুষ, জীবজন্তু বা বিশ্বব্রহ্মান্ডের যা কিছু সবই ঈশ্বরের সৃষ্টি – এর কখনও কোনো বিবর্তন ঘটেনি। যা প্রচার করা হচ্ছে তার সবটাই অপপ্রচার। সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
কেন্দ্রে আসীন সরকার নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য অনুযায়ী শিক্ষাক্রমকে পরিবর্তন করার নজির থাকলেও বিজ্ঞানকে অস্বীকার করার এই ধরণের প্রয়াস বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে চালিয়ে আসছে। পুরাণকে কল্পনাকে বিজ্ঞান বলে চালানো তার প্রথম প্রয়াস। আসলে পুরোনো ভারতকে ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ দেখিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রবর্তনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
গ্রাফিক্স: মনীষ দেব
Comments :0