RG Kar-HC

‘দলবদ্ধ’ ধর্ষণ হয়নি, সাত মাস পরেও বলতে পারল না সিবিআই

রাজ্য কলকাতা

আদালতে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলেও দলবদ্ধ ধর্ষণের সম্ভাবনা ঘটনার সাত মাস পরেও স্পষ্টভাবে খারিজ করে দিতে পারল না সিবিআই।

সোমবার কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ যখন সিবিআই আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন, আর জি করে ঘটনায় কি এক জনই জড়িত? তদন্ত করতে গিয়ে কখনও মনে হয়েছে এটা দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা? সিবিআই’র তরফে স্পষ্টভাবে এই সম্ভাবনা সোমবার খারিজ করা হয়নি। 

আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, তদন্তের সাত মাস পরেও যদি দলবদ্ধ ধর্ষণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার অবকাশ থাকে, তবে প্রথম দফার চার্জশিটে কেবলমাত্র এক সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধেই চার্জশিট দায়ের কেন? সেই চার্জশিট দায়েরের পাঁচ মাস পরেও আর জি করের ধর্ষণ-খুনের মামলায় অতিরিক্ত চার্জশিট রুজু করতে পারেনি কেন সিবিআই?

আর জি করে তরুণী চিকিৎসক-ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা কি পরিকল্পিত? এত বড় নৃশংস ঘটনায় কেবল এক জনই জড়িত? ময়নাতদন্ত কি সঠিক ভাবে হয়েছে? সিসিটিভির ফুটেজ কি যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়েছে? সরকার বা প্রশাসন বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি কোনও কিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে? ঘটনাস্থল কি চারতলাতেই? নিছক এক ব্যক্তির হঠাৎ যৌন তাড়না, না কি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পিছনে রয়েছে অন্য কোনও উদ্দেশ্য? গত ৯ আগস্ট থেকে রাজ্যবাসী এই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে মরিয়া। উত্তর জানতে রাজপথে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাত জেগেছেন, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাতে শামিল হয়েছেন বিচারের দাবিতে। একটি প্রশ্নের উত্তরও এখনও সোজাসুজি জানাতে পারেনি সিবিআই।

গত ৭ অক্টোবর নিম্ন আদালতে আর জি করে কর্মরত চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের মামলায় চার্জশিট দিয়েছিল সিবিআই। তার ঠিক ১১ দিন পরে নিম্ন আদলতের শুনানিতেই সিবিআই দাবি করে, ‘‘ধৃত প্রাক্তন অধক্ষ্য সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। দু’জনের মধ্যে ফোনের কল রেকর্ড ও মোবাইলের সিএফএসএল রিপোর্ট হাতে এসেছে। দু’জনের মোবাইলে ঘটনাস্থলের ভিডিও পর্যন্ত মিলেছে। দু’জনেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা এখন সেটাই দেখছি যে, ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত কি না। সঞ্জয় রায় আর জি কর কলেজে আসত। সন্দীপ ঘোষ অধ্যক্ষ ছিলেন। অভিজিৎ মণ্ডল টালা থানার ওসি ছিলেন, যার অন্তর্গত আর জি কর। ফলে এদের মধ্যে কোনও যোগসূত্র ছিল কি না, ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত কি না তা, আমরা এখন তদন্ত করে দেখছি।’’ 

আদালতে এমন সম্ভাবনার কথা পাঁচ মাস আগে জানালেও তারপরে সেই তদন্তের অগ্রগতি কোথায়, তা আর জানাতে পারছে না সিবিআই। নিম্ন আদালতে গত ১১ অক্টোবর এমন কথা জানানোর পরে ফের নভেম্বরে সিবিআই আদালতে জানায়, সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে বায়োলজিক্যাল তথ্য প্রমাণ মিলেছে। তাই প্রথম দফার চার্জশিটে তার নাম যুক্ত করা হয়েছিল। তার অর্থ এই নয় যে, আর কেউ যুক্ত নয়। অথচ সেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দপ সংস্থার তদন্তকারী আধিকারিক সীমা পাহুজা গত ১৩ ডিসেম্বরে আদালতে ৯০ দিন পেরিয়ে গেলেও ‘যথেষ্ঠ প্রমাণ’ না থাকায় দ্বিতীয় চার্জশিট দিতে না পারার কথা অবলীলায় জানিয়েছেন। ফলাফল? ধর্ষণ-খুনের মামলায় জামিন পেয়ে যান সন্দীপ ঘোষ, অভিজিৎ মণ্ডল। অক্টোবরের অবস্থান ডিসেম্বর কেন বদলে গিয়েছিল? নিছকই অপদার্থতা না কি অন্য কোনও চাপ বা প্রভাব? স্বাভাবিকভাবেই আরও জোরালো হচ্ছে সেই প্রশ্ন।

গত ৯ আগস্ট আর জি করের সেমিনার রুমে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকা চিকিৎসক-ছাত্রীর দেহের কয়েক ফুট দূরত্বে বহিরাগতদের প্রায় মেলার মতো ভিড় করে থাকার যে ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছিল, তা পর্যন্ত ‘তথ্য প্রমাণ’ হিসাবে চার্জশিটে উল্লেখ করতে পারেনি সিবিআই। ৯ আগস্ট রাতে কেন অতি তৎপর হয়ে পুলিশ দেহ দখল করে মা-বাবার অনুমতি ছাড়াই সোদপুরের বাড়িতে নিয়ে যায়, তাঁদের সম্মতি ছাড়াই দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের কোনও সুযোগ না রেখে তৎপর হয়ে শাসক তৃণমূলের নেতাদের উদ্যোগে দেহ কেন দ্রুত সৎকার করা হলো, তা অন্তত ‘তথ্য প্রমাণ লোপাট’ হিসাবে প্রথম চার্জশিটে গণ্য করেনি সিবিআই। কেন সকালে দেহ উদ্ধার হওয়ার পরে রাতে এফআইআর নেওয়া হলো, কেন মা-বাবাকে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখেও দেখতে দেওয়া হয়নি দেহ, তা আদালতে জানালেও প্রথম চার্জশিটে উল্লেখ করার ‘নিরপেক্ষতা’ দেখাতে পারেনি সিবিআই। আদালতে সন্দীপ ঘোষ আর টালা থানার প্রাক্তন ওসি’র কথোপকথনেই তথ্য প্রমাণ লোপাট, ঘটনার পরে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার তথ্য মিলেছে বলে জানালেও সেুটুকু পর্যন্ত উল্লেখ করে দ্বিতীয় দফার চার্জশিটও দায়ের করতে পারেনি সিবিআই!

এই প্রসঙ্গে এএইচএসডি’র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মানস গুমটা বলেছেন, গোটা দেশের অন্যতম বড় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। আর জি করের মতো ঘটনা, যা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল, গোটা রাজ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমেছিলেন যে ঘটনায়, সেই ঘটনাতেও সিবিআই’র তদন্তের এই হাল দেখে কেন্দ্রীয় সংস্থার প্রতি মানুষের যেটুকু আস্থা ছিল, তাও শেষ হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের ভিতরে এত নৃশংস ঘটনার তদন্তে সিবিআই’র যা হাল, তা সত্যি উদ্বেগজনক। মানুষ এখনও ন্যায় বিচারের দাবিতে এককাট্টা আছেন। কলকাতা পুলিশের চেহারা তো সবাই দেখেছেন। সিবিআই যদি তদন্তকে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়, তবে মানুষ আবারও রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন।

Comments :0

Login to leave a comment