MUKTADHARA PROBANDHA 31 MAY

কাঁটার শহরে গোলাপের ঘ্রাণ : গণশক্তি, মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

2023  MUKTADHARA PROBANDHA 31 MAY

কাঁটার শহরে গোলাপের ঘ্রাণ 

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রায় এক দশক ধরে বাতিল রাখার পর, আরব লিগ এ বার সিরিয়ার সদস্য পদ ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট, ‘বাশার আল আসাদ’ সশরীরে সৌদি আরবের জেড্ডায়, আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে পৌঁছে গেছেন। বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধপরাধ এবং রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের মতন মারাত্মক সব অভিযোগ রয়েছে এবং  পশ্চিমের দেশগুলো আসাদের সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনায় সায় দেয়নি, এমনকী অনেক আরব দেশও এখনই সিরিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী নয়, কাতার তো সিরিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সম্ভাবনা সরাসরি উড়িয়ে দিয়েছে। আসাদের মতন একজন নেতা কখনই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন, তবু এই আরব লিগ শীর্ষ সম্মেলন থেকে সিরিয়া, গৃহযুদ্ধ বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ সংগ্রহ করতে পারে কি না সেদিকে সমগ্র বিশ্বের নজর থাকবে।

ঠিক এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আজ যে সময়ের কথা লিখতে বসেছি,
তার প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১১ সালে শুরু হয়ে গেছে সিরিয়ার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ, যে যুদ্ধের  লেলিহান শিখা আজও অসংখ্য নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। এই গল্পটা, সেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার একজন স্বঘোষিত প্রধান গ্রন্থাগারিক, চোদ্দ বছরের আমজাদের গল্প। এই গল্প, গুটিকয় হার না মানা বইপ্রেমীর গল্প। এই গল্প, কাঁটার শহরে গোলাপ ফোটার গল্প। ‘সিরিয়া’, যেখানে বুলেট এবং মৃত্যুই নিয়ম, যেখানে মানুষের ঘুম ভাঙে বারুদের গন্ধে আর দিনান্তে জীবন যদি থাকে তবে মর্টারের আওয়াজ হয় ঘুমপাড়ানি গান। এইরকম জায়গায় বই পড়ার ইচ্ছে আর সময় দুটোই বাড়ন্ত। সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে দামাস্কাসের পাঁচ মাইল দূরে অবস্থিত ‘দারায়া’ শহরে, কিছু অত্যুৎসাহী দৃঢ়সংকল্প মানুষ, যারা মূলত ছাত্র, যে রূপকথার জন্ম দেন, সেই রূপকথা আজ বিশ্বখ্যাত, ‘Syria’s Secret Library’ হিসেবে।   দারায়া শহর, সেইসময় আসাদপন্থী যোদ্ধাদের দ্বারা প্রায় চার বছর অবরুদ্ধ, মারা গেছেন দু’হাজারের বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্করহিত সাধারণ নাগরিক, অথচ এই অবরোধকালেই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের ছাত্র, ‘আনাস আহমেদ’ এবং তার অন্যান্য ছাত্র বন্ধুরা প্রাণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে 
শহরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধারাবাহিকভাবে বই সংগ্রহ করে, পরম মমতায় কম্বলে মুড়ে নিয়ে আসেন এমন একটি বাড়ির বেসমেন্টে, যে বাড়ির ওপরতলাগুলো গোলা গুলিতে ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত। শুরু হয় এক অভিনব গোপন গ্রন্থাগারের। আনাস আহমেদ পরে সাংবাদিকদের জানান, যেকোনও সময় স্নাইপারদের গুলিতে তাদের প্রাণ যেতে পারত, তার জন্য চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হত তাদের, কিন্তু তাদের আর কোনও উপায় ছিল না। স্কুল, কলেজের বন্ধ দরজা তাদের ছাত্র জীবনে যাতে ইতি ঘটাতে না পারে, তার জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল একটি গ্রন্থাগারের।

নয় নয় করে সংগৃহীত সেই বইয়ের সংখ্যা চোদ্দ হাজার এবং চোদ্দ বছরের
কিশোর আমজাদ হয়ে ওঠে এই গ্রন্থাগারের স্বঘোষিত প্রধান গ্রন্থাগারিক। আমজাদ এক জাবদা খাতায় লিখে রাখে কে কোন বই ধার নিল আর বাকি সময়ে এক স্বর্গরাজ্য ওর হাতের মুঠোয়, একদম ওপরের তাকের বইগুলো নিয়েই একটু সমস্যা, বড়দের সাহায্য ছাড়া আমজাদের নাগালের বাইরে সেই বইগুলো। সপ্তাহে একদিন করে এই গ্রন্থাগারে ইংরেজি, গণিত এবং সাহিত্য বিষয়ক ক্লাস নেওয়া হয়। আমজাদ তার বন্ধুদের বোঝায় যে তোমাদের তো এখন টেলিভিশন নেই, তা হলে লাইব্রেরিতে এসো, বই পড়ো, দেখো কত মজা। শুধু তাই নয়, স্বেচ্ছাসেবীরা এই গ্রন্থাগারে পড়াশোনা করে জেনে নিয়েছেন কীভাবে তারা যুদ্ধে আহত মানুষের শুশ্রুষা করতে পারেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের  প্র্যাকটিকাল ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ ছিল না, বই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা।
শহর রক্ষার্থে যেসব যুবক অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, তারাও সুযোগ পেলে এই গ্রন্থাগারে এসে বই পড়েছেন, অনেক কিশোর-কিশোরী জানিয়েছে খিদে ভুলতে তারা এই গ্রন্থাগারে বইতে ডুব দিয়েছে, তা ছাড়া উপরের গোলগুলির হাত থেকে নিস্তার পেতে, বেসমেন্টের এই গ্রন্থাগার তাদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছিল।

দারায়া শহরের এই গ্রন্থাগার এবং সেখানকার গ্রন্থকীটের দল দেখিয়ে দিয়েছিলেন মৃত্যুভয়ের মধ্যে লক্ষ্যে অবিচল থেকেও কীভাবে জ্ঞান সমুদ্রে সাঁতার কাটা যায়। শতকোটি কুর্নিশ ক্ষুদে গ্রন্থাগারিক আমজাদ এবং তার সহযোদ্ধাদের। তাদের এই যুদ্ধের হাতিয়ারের নাম বই। এই হাতিয়ার মারণাস্ত্র হয়ে হত্যালীলায় মাতে না। ধ্বংস করে না প্রকৃতিকে, বর্তমান এবং অনাগত প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত করে না। এই হাতিয়ার বিজ্ঞান, দর্শন এবং সাহিত্যের হাত ধরে মানুষকে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের আশ্বাস দেয়, কাঁটার শহরে বারুদের গন্ধকে ম্লান করে এনে দেয় গোলাপের ঘ্রাণ। আর, জ্ঞানের আলোকে মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়। দারায়া শহরের এই গ্রন্থাগার, বধ্যভূমিতে একটুকরো মরুদ্যান হয়ে ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের ধ্রুবতারা হয়ে চিরকাল বিরাজ করবে, যার প্রাসঙ্গিকতা কখনও অমলিন হবে না। আমজাদ এবং তার সহযোদ্ধাদের এই যুদ্ধে নিশ্চিত জয়ের কথা হলপ করেই বলতে পারি, জ্ঞানের তো পরাজয় নেই। আর, সত্যিই যদি আরব লিগের কুটনৈতিক প্রচেষ্টার হাত ধরে, সিরিয়া শান্তির পথে ফিরতে পারে, তবে দারায়া শহরের এই গোপন গ্রন্থাগার যে মানুষ গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপন করে রেখেছে, সেই ভিতের উপর বেড়ে ওঠা মানুষেরা সিরিয়াকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে আগামীতে আলো দেখাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যুদ্ধমুক্ত সিরিয়া, যুদ্ধমুক্ত পৃথিবীর জন্য সমস্ত মুক্তমনা মানুষের সামনে আগামীতে একটি দিকচিহ্ন হিসেবে লড়াইয়ে বিবেচিত হবে, দারায়া শহরের এই গোপন গ্রন্থাগার।

তথ্যসূত্র : 
Syria’s Secret Library by Mike Thomson
BBC NEWS 
ক্ষুদে গ্রন্থাগারিক আমজাদের ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।

 

Comments :0

Login to leave a comment