MUKTADHARA PROBANDHA 7 JUNE

প্রবন্ধ - আগ্রাসী জাতীয়তার বিপ্রতীপে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতাবোধ : প্রসঙ্গ 'মুক্তধারা'

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA NEW  PROBANDHA 7 JUNE

আগ্রাসী জাতীয়তার বিপ্রতীপে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতাবোধ : প্রসঙ্গ 'মুক্তধারা'

পল্লব মুখোপাধ্যায়



মিলন ও সম্প্রীতি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতাবোধের প্রতিভাসে অমলিন। 'মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে
বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। .....মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি
অপরাধ বলে মনে করি।' মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর চিরদিন গুরুত্ব দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনের
শেষদিন পৰ্যন্ত প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবেসেছেন। তাঁর কাছে মানবধর্মই শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম। সভ্যতা, শান্তি, প্রগতিকে
অটুট রাখতে এর বিকল্প নেই। রবীন্দ্র নাটকে মিলন ও সম্প্রীতিবোধ আলম্বিত বিষয়। রবীন্দ্রনাথ নাট্যকার, নাট্য
পরিচালক, নাট্য প্রযোজক এবং অনন্য ব্যক্তিত্বময় সুদক্ষ অভিনেতা। ব্যাপ্ত জীবনে তাঁর এইসব নাট্য বিষয়ক
ভূমিকাও অবিস্মরণীয়।


'মুক্তধারা' নাটকের প্রকাশকাল ১৩২৮ বঙ্গাব্দের পৌষ সংক্রান্তি। ইংরেজি ১৯২২ সালের জানুয়ারী মাস।
রবীন্দ্রনাথ ইতিমধ্যে জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশ ঘুরে এসেছেন। বিশেষজ্ঞের মতে, 'মুক্তধারা'
নাটকের বিষয়বস্তু ও বিন্যাসের চিন্তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপ এবং পরবর্তী ভারতীয় ঘটনাভিত্তিক।
কোনও কোনও সমালোচকের মতে, রবীন্দ্রনাথ 'মুক্তধারা' নাটকে হিংসাত্মক জাতীয়তা ও যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে
সোচ্চার হয়েছেন। আবার কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে, মুক্তধারা বাঁধবার যন্ত্র এবং ভৈরবের ত্রিশূলের প্রতীক
দিয়ে নাট্যকার বোঝাতে চেয়েছেন ভৈরব যে জল মানুষের জন্য দিয়েছেন অর্থাৎ মানুষমাত্রেই প্রকৃতির যে
সম্পদের অধিকারী তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। সমালোচকের
দৃষ্টিকোণে অবিরাম গতিতেই জীবনের সার্থকতা, গতি জীবনের স্বরূপ, বদ্ধজীবনের প্রতীক মুক্তধারার বদ্ধজল,
রুদ্ধ জীবনের প্রতীক নন্দী সংকটের রুদ্ধ পথ। রবীন্দ্র নাট্যসমালোচকদের একটি অংশের মতে, এই নাটক আদতে
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে দেশবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি রূপক। উত্তরকূটের রাজা ও তাঁর উদ্ধত
প্রজাদের সংলাপ থেকে প্রতীয়মান হয় যে তাঁদের ভাষা আদতে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের ভাষা। শিবতরাইয়ের পশম
যাতে বিদেশের হাটে বেরিয়ে না যায় তার জন্য নন্দী সংকটের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়
ইংরেজ কী কৌশলে ভারতীয় তুলো, রেশম, পশম শিল্পকে ধ্বংস করেছিল। এই নাটকে অত্যাচারী বিদেশি রাজার
বিরুদ্ধে একটি দেশের প্রজার লড়াই। যন্ত্ররাজ বিভূতি কামারের ছেলে আজকের টেকনোক্র্যাটদের সঙ্গে তুলনীয়।

সে ওই বাঁধ বাঁধার যন্ত্র সৃষ্টি করেই খুশি। এর ফলে কার কী ক্ষতি হল তা নিয়ে বিভূতির বিশেষ মাথাব্যথা নেই।
অন্যদিকে অভিজিৎ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজার ছেলে ছিল না। সে নিজেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে গণ্য করেছে এবং
নন্দীসংকটের প্রাচীর ভেঙে ও মুক্তধারার বাঁধ কেটে মৃত্যুবরণ করেছে। অভিজিৎ এ কাজ উত্তরকূটের ক্ষতি
করার জন্য করেনি। সে চেয়েছিল অন্য দেশকে শোষণ না করে উত্তরকূট যাতে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে তারই
ব্যবস্থা করতে। কোনও কোনও সমালোচক-এর মতে, অভিজিতের পদ্ধতি হল ক্ষুদিরাম ও কানাইলাল-এর পন্থা।
চরমপন্থী কাজে আত্মদানের পদ্ধতি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকের কিছু অংশ তিনি
সচেতনভাবেই এই নাটকে এনেছেন। ধনঞ্জয়ের মুখে নাট্যকার বলিয়েছেন, 'যত মাতিয়েছি - তত পাকিয়ে তুলিনি।'
সমালোচকের মতে, নিছক আবেগে মত্ত মানুষ দিয়ে সংগ্রাম করতে গেলে কেবল সংগ্রামীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না
আন্দোলনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিহাস সাক্ষী চোরিচৌরার পুলিশ ফাঁড়ি আন্দোলনকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে
গান্ধীজী অহিংসা অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। এই নাটকের চরম মুহূর্ত হল গোপনে অভিজিৎ কতৃক
বাঁধ ভেঙে দেওয়া এবং সেই বাঁধের জলের তোড়ে আত্মদান করা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিবিধ
ধারাগুলির মধ্যে অন্যতম অহিংস ধারা ও সশস্ত্র সংগ্রাম। নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ সে সম্পর্কে ইতিহাসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি
ও অবস্থান নিয়েছেন।

Comments :0

Login to leave a comment