মণিপুরের দুই মহিলাকে নগ্ন করে রাস্তায় ঘুরিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের সেই নির্মম ঘটনার পর এক বছর কেটে গেল। উত্তর-পূর্বের বিজেপি শাসিত এই রাজ্যে জাতি সংঘর্ষ শুরুর পরের দিনই নৃশংসতার শিকার হন ওই দুই মহিলা। তাঁরা পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলেন, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই পাননি। বিজেপি সরকার বহু চেষ্টা করেছিল এই ঘটনা চেপে রাখার, কিন্তু দু’মাসের মাথায় তা ‘লিক’ হয়ে যায়। গোটা দেশ শিউরে উঠেছিল। আর প্রধানমন্ত্রী? কয়েক মাস পরে মিনিট দুই খরচ করে হালকা সমবেদনা ছাড়া তাঁর দিক দিয়ে আর কোনও হেলদোল আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। এই এক বছরে তিনি একবারও মণিপুরে যাননি। এর মধ্যে আরও বহু মহিলা ধর্ষণ হয়েছে, ঘরছাড়া হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন— আর নরেন্দ্র মোদী দেশজুড়ে মহিলাদের সঙ্গে অপরাধে অভিযুক্তদেরই আরও বড় পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছেন। ব্রিজভূষণ শরণ শর্মা থেকে প্রজ্বল রেভানা, মোদীর নির্লজ্জতার প্রকট উদাহরণ।
বিজেপি’র শরিক জেডি(এস) সাংসদ প্রজ্বল রেভানা এবারও লোকসভা ভোটের প্রার্থী। হাসান কেন্দ্রেই দাঁড়িয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় দফায় ভোট মিটতে না মিটতেই কূটনৈতিক ভিসার সদ্ব্যবহার করে তিনি পালিয়েছেন জার্মানিতে। যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত এই প্রজ্বলের জন্যই ক’দিন আগে ভোটভিক্ষা করেছেন মোদী। প্রায় তিন হাজার ভিডিও’তে প্রজ্বলের সমস্ত কুকীর্তির প্রমাণ আছে। রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্বেরও তা অজানা নয়, ফলে পুরো বিষয়টি জানতেন মোদীও। তারপরও তিনি প্রজ্বলের সমর্থনে জনসভায় গালভরা ভাষণ দিয়েছেন। এখন প্রজ্বল পলাতক, আর মোদী নীরব। ভিডিওগুলির অধিকাংশই প্রজ্বলেরই করা। বাড়ির পরিচারিকাদের উপর শারীরিক অত্যাচার চালিয়ে তাঁদের ভয় দেখাতেই ওই ভিডিওগুলো ব্যবহার করত সে। কর্নাটকের কংগ্রেস সরকার সিট গঠন করেছে। প্রজ্বলের বিরুদ্ধে জারি হয়েছে লুকআউট নোটিসও।
উত্তরাখণ্ডের পওরির বাসিন্দা ১৯ বছরের অঙ্কিতা ভাণ্ডারির কথা গোদী মিডিয়ার সুবাদে সাধারণ মানুষ ভুলেই গিয়েছেন সম্ভবত। বিজেপি নেতা বিনোদ আচার্যের ছেলে পুলকিত আচার্যের রিসর্টের রিসেপশনিস্টের কাজে ঢুকেছিলেন অঙ্কিতা। তাঁকে দিনের পর দিন শারীরিক অত্যাচারের পর খুন করে পুলকিত। রিসর্টের অন্য কর্মীরা ভয়ে প্রাথমিকভাবে মুখ খোলেননি। পরে কয়েকজন জানিয়েছেন, অঙ্কিতাকে লাগাতার যৌন নির্যাতন করত পুলকিত। লোক দেখাতে বিনোদকে বিজেপি বহিষ্কার করে। কিন্তু পুলকিত সহ মোদী-রাজে মহিলাদের উপর অত্যাচারে অভিযুক্তদের কারোরই কোনও কঠোর শাস্তি হয়নি। উলটে ধর্ষক, যৌন নির্যাতনকারীদের বাঁচাতে তৎপর থাকে মোদী বাহিনী। উত্তর প্রদেশের হাথরস, জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়া সেই প্রমাণ দিয়েছে। নারীশক্তি নিয়ে বিরাট লম্বাচওড়া কথা বলতে বলতে মোদী-শাহের নির্দেশে বেকসুর খালাস হয়ে যায় বিলকিস বানোর ধর্ষকরা। সেই ধর্ষকদের মালা পরিয়ে, সংবর্ধনা দিয়ে বিজেপি’রই জনসভার মঞ্চে তোলা হয়। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিটেক পড়ুয়া তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করেছিল বিজেপি আইটি সেলের তিন কর্মী। মোদীর সঙ্গে তাঁদের ছবি ঘনিষ্ঠতারই প্রমাণ দেয়। মধ্য প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার কর্মসূচিত গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁদের ঘাড়েই। তাই অভিযোগ উঠলেও ধর্ষকরা বিজেপি’র প্রচারে ব্যস্ত থাকায় ‘ছাড়’ পেয়ে যান। গ্রেপ্তার করা হয়নি মাস খানেক। মাথার উপর ছাতা ধরে নেন মোদী? উত্তর প্রদেশের উন্নাওয়ের বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ২০১৭ সালে। প্রবল আন্দোলনের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে তাঁকে জেলবন্দি করতে হয়েছিল। কিন্তু জেলে বসেই সেঙ্গারের পরিকল্পনায় ধীরে ধীরে নির্যাতিতার পরিবারের বহু সদস্য প্রাণ হারান। সাজানো দুর্ঘটনায় নির্যাতিতা এবং তাঁর আইনজীবীকে মেরে ফেলার ছকও কষেছিলেন বিজেপি বিধায়ক। একটি ঘটনাতেও মোদীর কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৫ সালে মোদী হরিয়ানা থেকে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয়েছিল কুস্তিগির সাক্ষী মালিককে। সাক্ষী তখন সদ্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে পদক জিতেছেন। তাই তাঁকে মুখ বানিয়ে মোদী নিজের পিঠ চাপড়ানোর সুযোগ ছাড়েননি। কিন্তু সেই ‘মুখ’ এবং আরও কয়েকজন যখন বিজেপি’র বাহুবলী সাংসদ, জাতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ তুললেন তখন মোদী হয়ে গেলেন বোবা-কালা। পকসো’তে অভিযোগ দায়েরের পরও ব্রিজভূষণকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। উলটে তিনি প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বেরিয়েছেন। একাধিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ব্রিজভূষণকে সাংসদ পদ থেকে বহিষ্কার করেননি মোদী। ন্যায়ের দাবিতে সাক্ষী মালিক, বীনেশ ফোগটরা রাস্তায় পড়ে মার খেয়েছেন আর ব্রিজভূষণ নতুন সংসদ ভবনে গিয়ে ‘পোজ’ দিয়েছেন। উত্তর প্রদেশের কাইসেরগঞ্জের সাংসদ ব্রিজভূষণ। ‘ক্লিন ইমেজ’ রাখার চেষ্টা করে ব্রিজভূষণকে প্রার্থী না করলেও তাঁর ছেলেকে টিকিট দিয়ে মোদী যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত সাংসদকে তুষ্ট করেছেন ঠিকই।
অশান্ত মণিপুরের এক বছরই হোক বা মোদী-রাজের দশ বছর বারবার স্পষ্ট করেছে, বিজেপি’র লোক মানেই ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, গার্হস্থ্য হিংসা সহ মহিলাদের উপর যাবতীয় অন্যায়ের লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া। মহিলাদের চূড়ান্ত অসম্মানের ‘পারিশ্রমিক’ হিসাবে বরং মোদী-শাহের বাড়তি আসকারা পাওয়া যায়।
Manipur violence
বর্বরতার বর্ষপূর্তিতে শুধু মণিপুর নয়, গোটা দেশ দেখছে মোদী নারী নির্যাতনকারীদের পক্ষে
×
Comments :0