তখনও মিছিল শুরু হয়নি। রোদের তেজ বাড়ছে। রিজিয়া আহমেদের কাঁধে রক্ত পতাকা। পাশেই দাঁড়িয়ে হাড়োয়ার শালিপুর অঞ্চলের কুকুড়িয়া গ্রামের আরেক সাহসিনী মালতী গোলদার। জেদের প্রতিচ্ছবি কেমন হতে পারে? এদিন সকালে সন্ত্রাসদীর্ণ হাড়োয়ায় তার অনায়াস উত্তর হতে পারেন এই দুই মহিলাও।
‘হুমকি দিয়েও না পেরে শেষে ৩ লক্ষ টাকা দেবে, আমাকে বলেছিল তৃণমূলীরা। শর্ত ওদের দলে যোগ দিতে হবে। শেষমেষ এও বললো অন্তত যেন মুখে মাস্ক পড়ে হলেও তৃণমূলের মিছিলে হাঁটি। ওরা ভাবে সবাইকে কেনা যায়!’ গত পঞ্চায়েত ভোটে সিপিআই(এম)’র প্রার্থী ছিলেন রিজিয়া আহমেদ, ভোট লুটের কাছে হার মানতে হয়েছিল।
আর মালতী গোলদার? তৃণমূলী হামলার মুখে প্রতিরোধের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, পরিবারের ওপর হামলা, পালটা গ্রামের মহিলাদের নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবসে গত বছর গ্রামে লাল পতাকার তোলার জন্য তৃণমূলীরা তাঁকে নিয়ে মাঠে সালিশি সভা বসিয়ে বয়কটের হুমকি দিয়েছিল। ‘ওসব ভয়টয় কেটে গেছে আমাদের। মমতার সরকারকে ১৩ বছর দেখছি, আমাদের আর নতুন করে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা বিজেপি নই যে ভয় কাটাতে সেটিং করবো’।
এই মেজাজই দীর্ঘ সন্ত্রাসে অবরুদ্ধ হাড়োয়ার আজকের বাস্তবতা। বৃহস্পতিবার সকালে সেই হাড়োয়াতেই, ভয় উড়িয়ে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। হাড়োয়া বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। এখানে কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্ট প্রার্থী নিরাপদ সর্দারের সমর্থনে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। হাড়োয়ার পেয়ারা মোড় থেকে শুরু করে সেই মিছিল হাড়োয়া বাসস্ট্যান্ডের সামনে শেষ হয়।
সেখানেই মহম্মদ সেলিম বলেন, সন্ত্রাস ভাঙছে, মানুষ এগিয়ে আসছে। মোদীর দিন ফুরিয়ে আসছে, মোদীর দিন ফুরোলে মমতার দিন ফুরোতেও সময় লাগবে না। এখানে যেভাবে পঞ্চায়েত হয়েছে সেভাবে লোকসভার ভোট হবে না। সেটা ভালো বুঝতে পারছে তৃণমূলও। তাই বিজেপি’র পালে হাওয়া দিতে তীব্র মেরুকরণের বিষাক্ত খেলায় নেমেছে।
কীভাবে বিষাক্ত প্রচার তা উল্লেখ করেই মহম্মদ সেলিম বলেন রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রমকে টেনে আনা হচ্ছে প্রচারে। অথচ কোনওদিন আজ পর্যন্ত আরএসএস, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নামে কিছু কথা বলতে শুনেছেন মুখ্যমন্ত্রীর গলায়? বিজেপি’র বিরুদ্ধে কথা বলতে হলে তবে সরাসরি আরএসএস’এর বিরুদ্ধে বলুন একবার। বলুন আরএসএস খারাপ, বলুন বজরং দল, ভিএইচপি আসলে কী! তা না করে শুধু ভোট ম্যানেজ করতে, বিজেপি’র পালে শেষ দু’দফায় হাওয়া দিতে পরিকল্পিতভাবে উসকানি ছড়াবেন না। পশ্চিমবঙ্গে আসানসোল থেকে ধুলাগড়, কাঁকিনাড়া একের পর এক দাঙ্গায় কী ব্যবস্থা নিয়েছিল ওঁর সরকার? আসানসোলের ইমামের পুত্র খুন হলেন। মমতা ব্যানার্জি বাবুল সুপ্রিয়কে দাঙ্গাবাজ বলেছিলেন। ইমাম সাহেব ওঁর পুত্রের খুনিদের ক্ষমা করেছেন কিন্তু আইনে তো ক্ষমা করা যায় না! সেই ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছিল মমতার সরকার? উলটে বাবুল সুপ্রিয়কে এখন সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রীসভার বৈঠক করেন আর হাড়োয়া থেকে মিনাখা, সন্দেশখালি জুড়ে লুট, আদিবাদীদের জমি দখল, সন্ত্রাস চালাচ্ছে নির্বিচারে। তবে সেই দিন গেছে। এই ভোটে সাপ কামড়াতে পারবে না। কোন সিভিক পুলিশ ভোট কাড়তে পারবে না। সন্দেশালি হাড়োয়া, মিনাখাঁ, হাসনাবাদের মানুষ এবার সাহসের সঙ্গেই ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন’।
তখন ভরদুপুর, কাঠফাটা রোদের মহম্মদ সেলিম বলছেন। বাস স্ট্যান্ডের উলটোদিকে জনা কয়েক তৃণমূল কর্মী। তাঁদের দেখেই চায়ের দোকানে বসা এক ব্যক্তি বলে উঠলেন, শোন কথাগুলো। লক্ষ্মী ভাণ্ডার সরকার দিচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু তা বলে সারা বছর লুট করবি আর ভোট না দিলে লক্ষ্মী ভাণ্ডার বন্ধ করার হুমকি দিয়ে ভোটের প্রচার করবি, এসবে খেপে যাচ্ছে লোকজন।’ জানা গেল উনি তৃণমূলেরই সক্রিয় কর্মী ছিলেন একসময়।
মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘ প্রচার করা হচ্ছে তৃণমূল না জিতলে লক্ষী ভাণ্ডার বন্ধ হবে। আমরা বলছি তৃণমূল না জিতলে চুরি, লুট বন্ধ হবে। সরকারি প্রকল্প বন্ধ হবে না। বরং চুরি ঠেকাতে পারলে সরকারি প্রকল্পের আরও বিস্তার হবে। একই সঙ্গে হাড়োয়ার মানুষজনও জানেন বিজেপি হারলে এইসব প্ররোচনা, উসকানির রাজনীতিও বন্ধ হবে এখানে। বিজেপি হারলে তৃণমূলও হারবে। তাই তৃণমূলের মাস্তানদের বলছি- ভোট লুট করে নিজেরা বিপদে পড়বেন না। মমতা ব্যানার্জি শুধু নিজের পরিবারকেই বাঁচাবে। অনুব্রত থেকে শাহজাহান- ভোট লুটের নেতারা কিন্তু জেলে। কয়লা থেকে নিয়োগ দুর্নীতি সবেতেই থাকলেও চার্জশিট থেকে রেহাই পেয়েছে একমাত্র ভাইপো।’
কলকাতা হাইকোর্টে এসএসসি মামলায় যে ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল করেছিল সেই তালিকায় হাড়োয়ার বিধায়ক ঊষারাণী মণ্ডলের মেয়ের নামও ছিল। হাইকোর্টের রায়ের পরে একাধিক তৃণমূল নেতা চাপে পড়ে বেশ কয়েকজনের টাকা ফেরত দিয়েছে। টাকার তোলার কারবার চালিয়েছে খোদ বিধায়কের স্বামী মৃত্যুঞ্জুয় মণ্ডল। ‘প্রতিবাদ করলে আবার মিথ্যা মামলা, আমি যুব করি, আমার বিরুদ্ধে খুনের মামলাও দিয়েছে এই ভোটের সময়, আগাম জামিনে আছি’ বলছিলেন বছর পঁচিশের রাজ্জাক মোল্লা। সেই গ্রাম থেকেই এদিন যুবকরা এসেছিলেন দলবেঁধে। মিছিলের গোটা যাত্রাপথে অবরুদ্ধ এই তল্লাটের মানুষ মহম্মদ সেলিম, নিরাপদ সর্দারদের দিকে হাত নাড়লেন।
শুধু হাড়োয়া নয় বসিরহাট কেন্দ্রের বাদুড়িয়াতেও এদিন ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রোড শো হয়। মহম্মদ সেলিম, নিরাপদ সর্দার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিপিআই’র পল্লব সেনগুপ্ত, কংগ্রেসের আশুতোষ চ্যাটার্জি, কৃষকের আন্দোলনের নেতা মহম্মদ সেলিম গাইন। মিছিলের পরে সভায় সভাপতিত্ব করেন গোলাম মন্ডল। সভায় বর্ষীয়ান নেতা নিহারেন্দু চ্যাটার্জি উপস্থিত ছিলেন। বেলিঘাটায় টাকি রোডের ধারে জনসভাতেও বক্তব্য রাখেন মহম্মদ সেলিম, নিরাপদ সর্দার, বারাসতের বামফ্রন্ট প্রার্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, আহমেদ আলি খান, পল্লব সেনগুপ্ত, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হরিপদ বিশ্বাস, কংগ্রেস নেতা আশুতোষ চ্যাটার্জি, অমিত মজুমদার ও সভাপতিত্ব করেন ইমতিয়জ হোসেন।
Comments :0