দুই বছর আগে বলেছিলেন, খাওয়া আর জনসংখ্যা বাড়ানোর কাজ তো জানোয়াররাও করে। রবিবার সেই আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত দেশবাসীকে নিদান দিয়েছেন, অন্তত তিনটি বাচ্চার জন্ম দেওয়া উচিত। সঙ্ঘ প্রধানের দেশবাসীর তালিকায় নিশ্চিতভাবেই মুসলিমরা নেই। কারণ ২০২১ সালের বিজয়া দশমীর ভাষণে তিনি বলেছিলেন, হিন্দুদের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে আর মুসলিমদের বেড়ে যাচ্ছে। এদিন নির্দিষ্টভাবে কোনও ধর্মের কথা উল্লেখ না করলেও তিনি বলতে চেয়েছেন হিন্দুদের কথাই। সঙ্ঘ প্রধানের দাবি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.১ শতাংশের নিচে যাতে না যায়। সেই কারণে দুইয়ের বদলে তিনটি বাচ্চার জন্ম দিতে হবে। নাহলে সমাজ মরে যাবে বলে তিনি দাবি করেছেন।
বিশ্লেষকদের অভিমত, ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদীরা একটি আশঙ্কা তৈরি করে দিতে সক্ষম হয়েছেন যে, কিছুদিনের মধ্যেই মুসলিমরা হিন্দুদের জনসংখ্যাকে টপকে যাবে। কোনও তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে এর সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু এই ভয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেকাংশেই সফল আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদীরা। আরএসএস প্রধানের এদিনের বক্তব্য সেই অনুসারেই। এর আগে একাধিক হিন্দুত্ববাদী নেতা-নেত্রী হিন্দুদের অন্তত চারটি বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন। এবারে ভাগবত সরাসরি সেই নিদান দিলেন। বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ, মুসলিমদের অধিক সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং ধর্মান্তরকরণ— এই কারণগুলির জন্য নাকি দেশে হু হু করে বাড়ছে মুসলিম আবাদি। সোশাল মিডিয়া থেকে বিজেপি নেতা কর্মীরা ভাষণে, প্রচারে হামেশাই এই কথাগুলি বলে থাকে। যদিও সরকারি পরিসংখ্যানেই এর স্বপক্ষে কোনো যুক্তি মেলে না। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের গোয়েবলসীও প্রচারের তোড়ে ভেসে যায় সব যুক্তি। বাংলাদেশের মুসলিম অনুপ্রবেশকারী নিয়ে ভুয়ো প্রচারই ছিল সদ্য সমাপ্ত ঝাড়খণ্ডের ভোটে আরএসএস-বিজেপি মূল অ্যাজেন্ডা।
রবিবার নাগপুরে এক অনুষ্ঠানে ভাগবত বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি না হলে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া অতি উদ্বেগজনক। কোনও জাতির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.১ এর নিচে নেমে গেলে সেই সমাজের অবলুপ্তি ঘটে যাবে, এমনটাই নাকি দাবি করা হয়েছে সাম্প্রতিক গবেষণায় বলে জানিয়েছেন ভাগবত। ফলে বাইরে থেকে কোনও আক্রমণের দরকার পড়বে না, জনসংখ্যা কমে গেলে একা একাই ধ্বংস হয়ে যাবে ওই জাতি। এর আগেও বহু ভাষা ও সভ্যতা এ ভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সে জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কখনওই ২.১ এর কম হওয়া উচিত নয় বলে দাবি করে তিনটি করে সন্তানের জন্মের নিদান দিয়েছেন ভাগবত।
২০২১ সালে দেশে জনগণনা করায়নি মোদী সরকার। কিন্তু আনুমানিক হিসেবে চীনকে ইতিমধ্যেই ছাপিয়ে গেছে ভারত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ভারতের জনসংখ্যা ২০৬২ সালে চরমে পৌঁছবে। তখন প্রায় ১৭০ কোটি জনসংখ্যার দেশ হবে ভারত। তারপর থেকে ভারতে জনসংখ্যার হার কমতে থাকবে। কিন্তু ভাগবত বলছেন, জাতি অবলুপ্ত হয়ে যাবে তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে কর্নাটকের শ্রী সত্য সাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দীক্ষান্ত সমারোহে অংশ নিয়ে মোহন ভাগবত বলেছিলেন, খাওয়া এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কাজ তো জানোয়াররাও করে। শক্তিশালীরাই বেঁচে থাকবে এটা জঙ্গলের নিয়ম। মানুষের মধ্যে শক্তিশালীরা অন্যদের রক্ষা করে। তার আগের বছর বিজয়া দশমীর ভাষণ থেকে মুসলিমদের আক্রমণ করতেই সঙ্ঘপ্রধান বলেছিলেন, ১৯৫১-২০১১ সালের মধ্যে জনসংখ্য বৃদ্ধির হারে গভীর পার্থক্যের কারণে দেশের জনসংখ্যায় যেখানে ভারতে উৎপন্ন ধর্মগুলির অনুগামীদের অনুপাত ৮৮ শতাংশ থেকে কমে ৮৩.৮ শতাংশ হয়ে গেছে সেখানে মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত ৯.৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.২৪ শতাংশ হয়েছে। পরের বছরেও মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তু করেই নিশানা বেঁধেছিলেন ভাগবত। দাবি তুলেছিলেন, সকলের জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একইভাবে কার্যকর করতে হবে। জনসংখ্যার ভারসাম্যের পরিবর্তনের দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।
ভাগবতের বক্তব্যের পরেই তীব্র কটাক্ষ ধেয়ে এসেছে। আসাউদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, আগে মোদী বলেছিলেন, মুসলিম মহিলারা বেশি সন্তান উৎপাদন করেন। এখন ভাগবত আরও বেশি সন্তান উৎপাদনের কথা বলছেন। তাঁর কটাক্ষ, এই বার তাহলে আরএসএস’র লোকেদের বিয়ে করে নেওয়া উচিত। আরজেডি মুখপাত্র মৃত্যুঞ্জয় তিওয়ারি বলেছেন, বিজেপি’র নেতারা প্রায়ই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। এখন সঙ্ঘপ্রধান আরও সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা বলছেন। বিজেপি-আরএসএস সন্তানের জন্ম দেওয়া নিয়ে আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঝামেলা মেটাক। বিহারে বিজেপি’র জোট সঙ্গী জেডি (ইউ)’র পক্ষ থেকেও এমন মন্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। বিহারে নীতীশ কুমারের সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। এদিন জেডি (ইউ) মুখপাত্র অরবিন্দ নিশাদ বলেন, রাজ্য সরকারের তরফে বারবার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচার চালানো হলেও এই ধরনের মন্তব্য মানুষকে বিভ্রান্ত করবে।
Bhagwat Population
কমপক্ষে ৩ সন্তানের নিদান ভাগবতের
×
Comments :0