দীপক দাশগুপ্ত
যখন ইটভাটা ছিল না, অন্যভাবে ইট বানানো হতো, তখনও নদী থেকেই সাদা বালি তোলা হতো। বাড়ির ছাউনির জন্য যেমন টালি ব্যবহার হয়, সেই সময় থেকে এই ফিলিং বালি বা সাদা বালি ছাড়া টালি প্রস্তুত হতো না ও হয় না। ফলে কেউ কেউ বলছেন ২০০ বছর আগে থেকেই বালি তোলার কাজ চলে আসছে। নৌকা পিছু শ্রমিক ৪/৫ জন অবশ্যই প্রয়োজন; এই কাজে সব সময়ই জীবনের ঝুঁকি থাকে; বানের সময় কাজ করতে গেলে বা হঠাৎ বান এলে অনেক সময় শ্রমিকদের কাজ চলাকালীন মৃত্যুও ঘটে, মৃতদেহ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। নদীর বাঁধ সংলগ্ন অঞ্চলে এই বালি পাওয়া যায় না, মাঝনদী থেকে এই বালি তুলতে হয়।
এই সমস্ত শ্রমিক ও নৌকার দুরবস্থার কথা ভেবেই বামফ্রন্ট সরকার প্রতিটি নৌকাকে লাইসেন্স দেওয়া শুরু করেছিল। সমস্ত নদী থেকেই সাদা বালি তোলা হয়। তাই রাজ্যের সমস্ত নদীতে নৌকা শ্রমিকরা একাজে যুক্ত আছেন। আনুমানিক তাদের সংখ্যা ৫০,০০০ এর বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নৌকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিগত ‘‘আমফান’’ ও ‘‘ইয়াস’’ দুর্যোগে প্রায় সব নৌকাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার কোনও কোনও নৌকা ধ্বংস, ধূলিসাৎ হয়ে গেছে দুর্যোগের কারণে। এরফলে বহু নৌকা মালিক ঋণগ্রস্ত হয়ে আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত হয়ে দিন গুজরান করছেন।
আমাদের রাজ্যে কুলপি, নামখানা, কাকদ্বীপ, বারাসত, ঘাটাল, তমলুক, গেঁওখালি, সাঁকরাইল, মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি সহ রাজ্যের সমস্ত নদীতে ফিলিং বালি তোলার কাজ হয়ে থাকে। এই কাজে তাই দশ হাজার নৌকা ও ৫০ হাজার শ্রমিক যুক্ত আছেন।
নৌকাজীবী শ্রমিকরা যাদের কাছে সাদা বালি দেয় যেমন ইটভাটা ও তার ফোড়েদের। এরা কম মূল্য দিয়ে নৌকাজীবী শ্রমিকদের ঠকায়। ইটভাটায় বালির ফুট ধরে মেপে মূল্য দেয় না। সারা মরশুমে যা সাদা বালি লাগবে এদেরকে তা সাপ্লাই দিতে হবে। ইট যা গরম হয়, তার কমিশন প্রথায় মূল্য নির্ধারণ হয়। কিন্তু ইটভাটা মালিকরা তাদের মরজি মাফিক যা বলবে সেই অনুযায়ী মূল্য পায়।
ধরা যাক একটি ভাটায় পঞ্চাশ লাখ ইট গড়া হয়েছে। মালিক ইচ্ছাকৃতভাবেই সংখ্যা কমিয়ে দেয় এবং শ্রমিকরা মালিকের মরজি মাফিক মূল্য পায়। প্রচণ্ডভাবে ঠকানো হয় এই নৌকাজীবী শ্রমিকদের। ফোড়েদাররা কম দামে কিনে অনেক বেশি দামে বাজারে বিক্রি করে থাকে। শোষণ অব্যাহত হয়েছে;
শ্রমিকদের দাবিসমূহ :
(১) যুগ যুগ ধরে চলে আসা সাদা বালি তোলার কাজ বন্ধ করে গরিব মানুষের ক্ষতি করা চলবে না।
(২) নদীকে বৃহৎ সংস্থার হাতে লিজ দেওয়া যাবে না।
(৩) অপরাধীর মতো সাদা বালি তোলার কাজ করবো না। সরকারি অনুমতি দিতে হবে।
(৪) প্রত্যেক নদীকে আয়তন ও গভীরতায় পূর্বাবস্থায় ফেরাতে হবে।
(৫) নদী রক্ষণাবেক্ষণ ও ড্রেজিংয়ের নামে টাকা অপচয় বন্ধ করতে হবে।
(৬) ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল সহ রাষ্ট্রীয় সম্পদসমূহ বিক্রয় বন্ধ করতে হবে।
(৭) জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা কর্পোরেট সহ একচেটিয়া গোষ্ঠীর হাতে ভরতুকি তুলে দেওয়া যাবে না।
৮) অবিলম্বে পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন ও গ্যাসের দাম কমাতে হবে।
শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করো
সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করে শোষণ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে লাগাতার শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে তোলা আমাদের কর্তব্য। দেশের ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের সমস্ত শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের সকলকে ইতিবাচক কমিউনিস্ট সুলভ ভূমিকা পালন করা আবশ্যিক। এটা আমাদের বোঝাপড়ায় থাকা দরকার। নৌকাজীবী বা শ্রমিক, যারা পরিপূর্ণভাবে শোষিত; ওরা শোষিত সাদা বালির সঙ্গে যুক্ত ফোড়েদার, থানা পুলিশ, প্রশাসন ও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের দ্বারা। সমস্ত শ্রমিকদের প্রতি পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বন্ধুত্বের ও ভ্রাতৃত্বের; নৌকাজীবী শ্রমিকরাও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে। শ্রমিক ও অন্যান্য গণআন্দোলনের উপরে পুলিশি ও তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডাদের আক্রমণ ছিল না। মমতা ব্যানার্জির সরকারের শাসনে যা হচ্ছে।
‘‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’’ রণধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের শ্রষ্টা দুই মহান ব্যক্তিত্ব কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের কণ্ঠে। সত্যাদশী বৈজ্ঞানিক উক্ত আহ্বান অনুযায়ী বিশ্বের দেশে দেশে গোটা শ্রমিকশ্রেণির ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়েছিলেন মার্কসবাদীরা। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন। ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজে বিভেদকামী সঙ্কীর্ণতাবাদীদের বিরুদ্ধে জোরালো সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রবক্তাদের পক্ষ থেকে। আজও তা চলছে।
ভারতে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘‘সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন’’-এর প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে রণকৌশলগত লাইন স্থিরকৃত হয়েছিল... ‘‘ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি’’। বিগত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে সিআইটিইউ, ফলশ্রুতিতে বর্তমান সময়ে সিআইটিইউ বৃহৎ এক ট্রেড ইউনিয়ন হিসাবে গড়ে উঠেছে।
অতএব প্রতিটি শিল্প সংস্থায় শ্রমিক কর্মচারীদের ঐক্য গড়ে তোলা খুবই জরুরি। সুতরাং নৌকাজীবী শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজকে গুরুত্ব দিতে হবে। কোনও ব্যক্তি বা কোনও শ্রমিক সম্পর্কে কোনোরকম সঙ্কীর্ণতার বশবর্তী হয়ে যেন সমস্ত শ্রমিককে সংগ্রাম ও সংগঠনে টেনে আনতে কোনোরকম বাধা ও সমস্যা না হয়। এ কাজকে উদার ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। যে সমস্ত নদীতে এ ধরনের নৌকাজীবীরা রয়েছেন, তাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস চালানো প্রয়োজন। আলোচ্য সময়ে নয়া উদারনীতি প্রয়োগের কারণে দেশে ও রাজ্যে গিগ ওয়ার্কার্স, অটো, টোটো, রিকশা, ভ্যান চালক, ওলা, উবের, ট্যাক্সি চালক ও গৃহকর্মী প্রভৃতি নানা কাজে যুক্ত শ্রমিকরা রয়েছেন। নৌকা চালকরা নতুন নয়, দীর্ঘকাল ধরে উক্ত শ্রমিকরা কাজ করে চলেছেন। সম্প্রতি আমাদের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নতুন শ্রমিকদের সঙ্গে যেমন আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাদের ইউনিয়নকে সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার কাজ সিআইটিইউ চালিয়ে যাচ্ছে এবং বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করেছেন আমাদের কমরেডরা। নৌকাজীবীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ফলশ্রুতিতে আমাদের একাধিক কমরেড উদ্যোগ নিয়ে ইতিমধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলেছেন। রাজ্য সিআইটিইউ’র পক্ষ থেকে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সাহায্য ও সহযোগিতা করা হচ্ছে।
সিআইটিইউ’র নীতি অনুযায়ী শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের রাস্তায় নৌকাজীবী শ্রমিকদের টেনে আনার কাজ ওখানকার নবগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন চালিয়ে যাচ্ছে এবং আগামীদিনে তা আরও দৃঢ়ভাবে চালিয়ে যেতে হবে। শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ এক লড়াকু সংগঠন নৌকাজীবী শ্রমিকদের মধ্যে গড়ে তোলা আজ জরুরি ও প্রাসঙ্গিক। অতএব নয়া উদারনীতির এই আক্রমণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যেও আক্রান্ত শ্রমিকশ্রেণি ও অন্যান্য মেহনতি মানুষেরা প্রতিরোধের ময়দানকে আরও মজবুত করছেন।
নৌকাজীবী শ্রমিকরাও রাজ্যে তৃণমূল সরকার ও বিজেপি সরকারের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে যে কাজ করে চলেছে তাকে মোকাবিলা করার রাস্তায় অন্যান্য মেহনতি মানুষের সঙ্গে এক হয়ে লড়াই সংগ্রাম গড়ে তুলছে। সতুরাং সিআইটিইউ’র পক্ষ থেকে সর্বত্র এই নৌকাজীবী শ্রমিকদের সংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ করার কাজে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হওয়া আবশ্যক। এদের আন্দোলন সংগ্রাম এবং সংগঠন শক্তিশালী করার স্বার্থে সিআইটিইউ’র সমস্ত স্তরের কর্মী এবং সদস্যদের দৃঢ় ভূমিকা পালন করা জরুরি।
Comments :0