Post Editorial Ganashakti

সিনেমা নয়, ফতোয়া দর্শনের

সম্পাদকীয় বিভাগ

Post Editorial Ganashakti


শান্তনু চক্রবর্তী

অভিযোগটা অনেক পুরানো। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায়, রাজ্যসভার মনোনীত সাংসদ নার্গিস দত্ত বলেছিলেন, ‘পথের পাঁচালী’ বিদেশের বাজারে ভারতের দারিদ্র বিক্রি করে নাম কিনেছে। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে বলিউডের তারকা অভিনেত্রীর আরও বক্তব্য ছিল, এমন সিনেমাই বানানো উচিত, যেটা বিদেশে একটা সুখী, সম্পন্ন, উজ্জ্বল, উন্নত ভারতের ছবি তুলে ধরবে। ‘আত্মনির্ভর’ শব্দটা তখনও ভারতীয় রাজনীতির ন্যারেটিভ-এ আসেনি। তবে সমান্তরাল সিনেমায় যেমনটা দেখানো হয়, সেই মলিন, আঁধার, হতশ্রী ভারতীয় বাস্তবতার ছবিটা যে দেশে-বিদেশে কোথাও-ই প্রচারিত না হওয়াই উচিত, সে ব্যাপারে নার্গিসের সঙ্গে তখনকার রাজনীতি-সিনেমার অনেক ব্যক্তিত্বই একমত হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এমন একটা হাস্যকর বিতর্কে সত্যজিৎ নিজে বিশেষ একটা প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে ‘মাদার ইন্ডিয়া’র এই বলিউডি ‘দেশপ্রেম’কে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ তীক্ষ্ণ, তীব্র, ঝাঁঝালো ব্যঙ্গে বিদ্ধ করেছিলেন উৎপল দত্ত।
তার পর চার দশকে গঙ্গা-যমুনা-কাবেরী-গোদাবরী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। এই চার দশকে হিন্দি সিনেমার তথাকথিত সমান্তরাল বা অন্যধারা, শুকিয়ে মজে ‘মরা-নদীর সোঁতা’ হয়ে গেছে। এই বছরগুলোয় বলিউডের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতি ব্যাপক বদলে গেছে। ‘গ্লোবাল’ হতে হতে বলিউডই এখন ভারতীয় সিনেমার মুখ ও মলাট। সম্প্রতি দক্ষিণী জনপ্রিয় ছবি সেই সিংহাসন ধরে টানাহেঁচড়া শুরু করলেও, ‘পাঠান’-এ ভর করে ব‍‌লিউডের আবার তথাকথিত ‘কামব্যাক’ ঘটেছে। দেশভক্তদের ‘হ্যাসট্যাগ বয়কট পাঠান’-এর ডাককে পালটা ‘বয়কট’ করেই সেটা ঘটেছে। কিন্তু সে অন্য গল্প। ঘটনা হলো ২০১৪ সালে ভারতবর্ষে ৫৬ ইঞ্চি ছাতির দুর্জয় ‘রাষ্ট্রবাদী’, ‘প্রকৃত স্বাধীন’ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বলিউডে একটি অনুগত, ভক্ত-বাহিনী গড়ে উঠেছে— ভক্তিভাবে সমাচ্ছন্ন সিনেমা-টিনেমাও যথেচ্ছ বানানো হয়েছে। তারপরেও যাঁদেরকে বাগ মানানো যায়নি, তাঁদেরকে সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ ‘ভক্তিবাদী’ তড়িকায় যথাবিহিত বিড়ম্বনায় ফেলা গেছে। ‘পাঠান’ সেখানে একটা পালটা অন্তর্ঘাতের রাস্তায় কিস্তিমাত করেছে। পর্দার বাইরের একজন বিড়ম্বিত, ‘লাভ জেহাদি অপর’ এখানে পর্দায় চরম-চূড়ান্ত দেশপ্রেমিক বেশে কামাল করেছে।
কিন্তু সেটাও অন্য গল্প। আসল কথা হলো, যে ‘পথের পাঁচালী’ ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় প্রতিষ্ঠানের চোখ অস্বস্তিকর ছিল— এই ২০২৩-এর বসন্তে, স্বাধীনতার অমৃতকালে ভারত নাকি যখন ‘বিশ্বগুরু’ হব-হব করছে, তখনও হিন্দুত্ব-ব্রিগেডের বয়কটবাজরা সেই ছবিটাকে উপেক্ষা করতে পারছে না। তাই সম্প্রতি কটকের র‌্যাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম সোসাইটি আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী সিনেমা হিসাবে ‘পথের পাঁচালী’-র নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক তুলে দিল বিজেপি’র ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ। অভিযোগ সেই বস্তাপচা, পুরানো —ছবিটায় দারিদ্রকে মহান করা হয়েছে। হোক না সে ব্রিটিশ শাসনকালের কথা। কিন্তু ভারতের গ্রামীণ নিম্নমধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবার, যখন দারিদ্রের চাপে বাপ-ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সেখানে গ্রামের ভূমি-রাজনীতি, জমির মালিকানা, অধিকার, এসব প্রশ্ন উঠে পড়ে। আর কে না জানে, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর আমলেও গ্রামীণ ভারতে ভূমিসংস্কার একটা ‘নিষিদ্ধ’ শব্দই। ইংরেজি হরফে ‘পাঁচালী’-কে ‘পাঞ্চালী’ পড়ে যে সনাতন-ধর্মী ছাত্রবাহিনী মহাভারতের দ্রৌপদীকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া ভাবে, তাদের অজ্ঞতা-অশিক্ষা নিয়ে হাসাহাসি করতেই পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র উৎসবে ছবির তালিকায় ‘চারুলতা’র নাম দেখে যারা আপত্তি তোলে, তারা নিজেদের ‘সামাজিক-সাংস্কৃতিক’ মতাদর্শের লক্ষ্যে কিন্তু অর্জুনের মতোই স্থির। তারা তাই ঠিক বুঝে নেয়, দেওরের প্রতি ইন্দ্রিয়-আকর্ষণে, ‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’ চারুলতা কোথায় ‘শাশ্বত ভারতীয়’ (পড়ুন ‘হিন্দু’) পারিবারিক মূল্যবোধ (বা অববোধ)-এর সীমানা টপকাচ্ছে।
নব্য-হিন্দুত্ববাদীদের এহেন ফতোয়ায় আপনি ‍‌শিউরে উঠে ভাবতে পারেন, এই জমানায় যদি ‘গণশত্রু’ তৈরি হত, তাহলে সনাতন ধর্মের পবিত্র চরণামৃতে মারণ ভাইরাস খোঁজার দায়ে সত্যজিৎও অর্মত্য সেনের মতোই হিন্দুরাষ্ট্রের ঘোষিত গণশত্রু হিসাবে চিহ্নিত হতেন। আর ‘দেবী’র বিরুদ্ধে গেরুয়া-বাহিনী তো মাতৃশক্তির অবমাননার অভিযোগ তুলে রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এবং আরএসএস’র নবদুর্গা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ-প্রশাসনও হয়তো ইউনেস্কোর স্বীকৃতির কথা ভেবে সে যাত্রা নীরব-নিষ্ক্রিয়ই থেকে যেত। যাই হোক, কী হলে কী হতো, সেইসব হাইপোথিসিস ছেড়ে একটা কথা বরং পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। র‌্যাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসবে সত্যজিতের ছবি নিয়ে বিতর্ক তোলাটা আসলে বাহানা বা ওজর। এবিভিপি’র মূল টার্গেট ছিল উৎসবে ছবির তালিকার দু‍‌টি তথ্যচিত্র। একটি ‘হদ অনহদ: ‍‌জার্নিস উইথ রাম অ্যান্ড কবীর’। আর একটি কলকাতায় তৈরি ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’। ছবি দুটির নাম থেকেই পাঠক নিশ্চয় কিছুটা আন্দাজ‍‌ করতে পারছেন, সনাতনপন্থী ছাত্রদের আসল আপত্তির জায়গাটা ঠিক কোথায়। সবাই জানেন ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ‍‌নৈতিক উত্থানের ভরকেন্দ্র বা জ্বালানি হলেন রাম। ১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনে মাত্র ২টি আসন পাওয়া, বিজেপি স্রেফ রামমন্দির আন্দোলনে ভর করে পরের  নির্বাচনেই ৮৮টি আসন দখল করে। এবং ২০১৯-এ ৩০২টি আসনের ‘ব্রুট মেজরিটি’ – ধারী দলটি ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’-র স্লোগানটকে’ও প্রায় বাস্তব করেই ছে‍‌ড়েছে।
সেখানে শবনম ভিরমানির ‘হদ অনহদ’ বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের তৈরি করা সেই ধনুর্ধর, যোদ্ধা-বেশী, সংঘর্ষ-প্রবণ ‘রাজনৈতিক রাম’-এর উলটো রাস্তায় এই উপমহাদেশের হৃদয়ে বাস করা এক অসাম্প্রদায়িক, মানবিক রামের সন্ধান করেছে। লালকৃষ্ণ আদবানি তাঁর সোমনাথ থেকে অযোধ্যা দাঙ্গা-রথযাত্রায় মিলিট্যান্ট রামচন্দ্রকে সঙ্গী করেছিলেন— যাঁর ‘রামরা‍‌জ্যে’ ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজন করা হয়। কিন্তু শবনমের এই ‘রামযাত্রা’র সহযাত্রী সন্ত কবীর—যাকে হিন্দু-মুসলিম, মন্দির মসজিদ, মৌলবী-পুরোহিত গোছের কোনও পরিচয়ে বাঁধা যায় না! ভাগাভাগি, ছোঁয়াছুঁয়ি মানামানির সব ‘হদ’ বা বন্ধন পার হয়ে যিনি রামকে খুঁজেছেন ‘অনহদ’ বা বাঁধনছেঁড়া মুক্তির রাস্তায়। শবনমের তথ্যচিত্রটা শুরু হচ্ছে ২০০৩ সালের অযোধ্যা থেকে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের স্মৃতি তখন মাত্র ১০ বছরের পুরানো। গুজরাট গণহত্যার রক্তের দাগ এক বছরে একটুও শুকোয়নি। এই আবহে মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ধারে কাছে দেদার বিকোচ্ছে বাবরি ধ্বংসের সিডি, ডিভিডি। লোকে রামলালা, কল্পনার রামমন্দিরের ছবির সঙ্গেই স্মারক হিসাবেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন হিন্দু শৌর্যবীর্যের টাটকা প্রমাণ। বিক্রেতা ক্যামেরার সামনেই জানালেন, এই ভিডিও দেখলে নির্ভেজাল হিন্দু রক্তে জোশের তুফান ওঠে। ধ্বংসস্তূপের ওপরেই রামমন্দির নির্মাণের সংকল্প দৃঢ় হয়। মুঘলদের পাপের বদলা নিতে পারার জন্য হিন্দু হিসাবে গর্ব আর আত্মবিশ্বাস কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
এই উগ্র আক্রমণাত্মক সাম্প্রদায়িক রামভক্তির আঙিনা থেকে তথ্যচিত্রের ফোকাস সরে আসে কবীরে— তাঁর দোঁহায়- তাঁর সংস্কারহীন ভক্তি ও প্রেমের দর্শনে। তিনি জন্মসূত্রে হিন্দু না মুসলিম সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্যিটা হলো দুই ধরমের কট্টরপন্থীরাই অস্পৃশ্যের মতো তাঁর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতেন। অথবা এভাবেও বলা যায় যে, কবীরই দুটি ধর্মের সমস্ত গোঁড়ামি, অন্ধত্ব, প্রাতিষ্ঠানিকতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শবনম তাঁর সফ‍‌রে এই কবীরের রামকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন। তাঁর সেই সফর অযোধ্যা থেকে শুরু হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে চলে যাচ্ছে পাকিস্তানের করাচিতে। সেই যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গে দেখা হচ্ছে বিভিন্ন লোকসঙ্গীত শিল্পী আর কাওয়ালি গায়কদের। তাঁদের সুরে, কথোপকথনে, ভাবনার দর্শনে আবিষ্কৃত হচ্ছেন কবীর এবং রাম। এই রাম অযোধ্যার রাজা নন! ধরিত্রীকন্যা সীতার অসংবেদনশীল স্বামী নন। যুদ্ধের নামে নানারকম অনৈতিক কাণ্ডকারখানায় লঙ্কা জবরদখলকারী কোনও সাম্রাজ্যবাদী আর্য পুরুষ নন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই উপমহাদেশের সমস্ত মানুষের হৃদয়ে অন্তর মহলে তাঁর বাস। পশ্চিম রাজস্থানের লোকসঙ্গীত শিল্পী মুখতিয়ার আলি তো এই রামকে মনে রেখেই গেয়ে ওঠেন ‘রাম বিনা কোই ধামে নহি হায়’! এই গানই আবার শবনমের ছবির শীর্ষ সঙ্গীত হয়ে ওঠে। সীমান্তহীন রামকে চেনার, খোঁজার, বোঝার গান আলতো আদরের মতো ছুঁয়ে থাকে গোটা ছবিটার শরীর। এই রামকে চিনতেন সন্ত কবীর। যিনি বাবরি মসজিদ নির্মাণেরও অনেক আগে, ভক্তির শক্তিতে অন্ধবিশ্বাসের সমস্ত মন্দির-মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই রামকে জানতেন আমৃত্যু আমর্ম হিন্দু মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কিন্তু এই রামকে চিনতে চান না সাভারকর-গোলওয়ালকর, জিন্নাহরা! ভুলিয়ে দিতে চান মোদী-যোগী-অমিত শাহরা। নইলে এই একুশ শতকের পৃথিবীতে অন্যের ধর্মস্থানের শবদেহের ওপর নিজেদের অহঙ্কার আর সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতির মন্দির তৈরি করা যায় না। এঁদের ছাত্র-শিষ্যরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির ভেতর ‘হদ অনহদ’ দেখাতে দেবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
কবীর, নানক বা বুল্লে শাহ্‌র মতো ভক্তি ও সুফি আন্দোলনের সাধকরা ধর্মীয় বিভাজন পেরিয়ে মানুষের নেতা হতে চেয়েছিলেন। প্রাসাদ-রাজসিংহাসনের বাইরে মানুষের রাজা রামকে খুঁজতে চেয়েছিলেন। তাই মধ্যযুগের মৌলবী মহান্তরা যেমন তাঁদের অপছন্দ করতেন, তেমনই আজকের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারবারীরা তাঁদের বিপজ্জনক মনে করেন। একইভাবে দেবলীনা মজুমদারের ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি‘ ছবিটাও তাদের সমান সন্ত্রস্ত করবে। কারণ, বাবা রামদেব থেকে শুরু করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ্গ দল সুদ্ধ সঙ্ঘ পরিবারের নানান শরিকরা বারেবারেই বলেছে, সমকামিতা এক ধরনের ‘অসুখ’ আর সেই ‘অসুখ’-এর ভূত ছাড়ানোর দাওয়াই তাদের জানা আছে! ৩৭৭ ধারা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যাই বলুন, সঙ্ঘ পরিবার মনে করে, যৌন-রুচি বা পছন্দের এই স্বাধীনতা, সুস্থ-সভ্য-সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী এবং এটা স্বাভাবিক পারিবারিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করবে। শীর্ষ আদালতের হলফনামায় সে-কথা কেন্দ্রের সরকার বলেই দিয়েছে। ইদানীং আরএসএস রামায়ণ-মহাভারত-বেদ-পুরাণের উদাহরণ দিয়ে, সমকামিতা বিষয়ে নিজেদের একটা উদার মুখ তুলে ধরার চেষ্টা করলেও বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীদের মন্তব্যে মনের কথাটা বেরিয়ে আসে প্রায়ই। দেবলীনার ছবিটা তো সেখানে আরও বিপজ্জনক একটা সরণিতে হাঁটতে চেয়েছে। তিনি ভারতবর্ষে এখনো বেআইনি সমকামী-বিবাহের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে চেয়েছেন। সমকামী প্রেমের সম্পর্কটাকে কি বিবাহ নামক একটি আদিম পিতৃতান্ত্রিক বোঝাপড়ার বন্দোবস্তে শামিল করা সম্ভব অথবা উচিত? এই প্রশ্নটা নিয়েই দেবলীনা পৌঁছে গেছেন রাষ্ট্র, আদালত, প্রশাসন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে, এমনকি ‘এলজিবিটিকিউ’ গোষ্ঠীর নিজস্ব পরিসরেও।
ছবিটা শুরু হয় একটি সাধারণ বিষম লিঙ্গের বিচার প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠানের অনুপুঙ্খ দিয়ে। এখান থেকেই পরিচালক দেবলীনা এবং গবেষক-ছাত্র ও বামপন্থী রাজনৈতিক সায়ন ভট্টাচার্য একটা পরীক্ষায় মাতেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এসএফআই’র তরফে প্রথম সমকামী প্রার্থী গৌরব ঘোষ। তাঁরা বিয়ের ঘটকালি সংক্রান্ত একটি ওয়েব সাইটে নিজেদের জন্য যথাক্রমে উপযুক্ত পাত্রী ও পাত্র চেয়ে নির্দোষ একটি বিজ্ঞাপন দেন। ওয়েব সাইট কিন্তু তাঁদের বিশেষ চাহিদাকে কোনও গুরুত্ব না দিয়ে, নিজস্ব প্রোগ্রাম কোড মাফিকই তথ্য সরবরাহ করতে থাকে। এই খেলা খেলা পরীক্ষা থেকেই ছবিটা ক্রমশ একটা জটিল-গভীর ডিসকোর্স-এ জড়িয়ে পড়তে থাকে। সমকামী বিবাহের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিতর্ক ক্রমশ সামগ্রিকভাবে বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও নানা যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন তুলতে থাকে। সেখানে যেমন এঙ্গেলসের বিয়ে, পরিবার ও সম্পত্তির অধিকার নিয়ে তত্ত্বের কথা আসে, তেমনই নারীবাদী আন্দোলনের বাস্তব সীমাবদ্ধতা ও আপসের প্রসঙ্গও বাদ যায় না। আবার দুটি সমকামী নারীর তথাকথিত লোকাচার-মাফিক বিয়ে, সংসার, দাম্পত্য-সুখের বাস্তব আবেগটুকুকেও অগ্রাহ্য-অস্বীকার বা অসম্মান করা হয় না।
ফিল্মস ডিভিসন প্রযোজিত এই তথ্যচিত্রে দেবলীনা অবশ্যই কোনও স্পষ্ট সমাধান বা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাননি। শুধু কতগুলো সংলাপ আর প্রশ্ন তুলতে চেয়েছেন। কিন্তু আজকের মোদী-ভারতে তো প্রশ্ন তোলাটাই সবচেয়ে মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়। তাই শবনম-দেবলীনাদের ছবি নিষিদ্ধ হয়। তবে দেবলীনা ও তাঁর বন্ধুরা চাইছেন বিবিসি’র ‘ইন্ডিয়া: মোদী কোশ্চেন’ তথ্যচিত্রটির প্রদর্শনটাই যেমন সারা দেশে ছাত্র-যুবদের উদ্যোগে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড গণআন্দোলনের রূপ নিয়েছি এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেও সেভাবেই আওয়াজ উঠুক। এই রাজ্যের প্রগতিশীল ছাত্ররা এগিয়ে আসুক না।

Comments :0

Login to leave a comment