STORY — KHAGESHWAR DAS / NATUNPATA - 17 September

গল্প — বনির বাগান / নতুনপাতা

ছোটদের বিভাগ

STORY   KHAGESHWAR  DAS  NATUNPATA - 17 September

গল্পনতুনপাতা

বনির বাগান 
খগেশ্বর দাস

      আমাদের আট বছরের ছোট্ট মেয়ে বনি, তার কোনো বন্ধু নেই। কারণ আমাদের  কলেজ কোয়ার্টারে বনির সমবয়সি কোনো বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে নেই। তাই বনি সারাদিন কোয়ার্টারের সামনের বাগানে একা একা ঘুর ঘুর করে বিভিন্ন গাছেদের সঙ্গে খেলা করে, তার যত গল্প এই গাছেদের সঙ্গে। গাছেদের তার দেয়া বিভিন্ন নাম আছে, সে  সব  নামেই সে গাছেদের ডাকে। গাছেরাও হাওয়ায়  মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তার কথায় সায় দিয়ে যায়। কখনো কখনো গাছেরা, বিশেষ করে ছোটো চারাগাছেরা বনির ছেলেমেয়ের মতো। বনির মা বনিকে  যে ভাবে শাসন করেন, দুষ্টুমি করলে বকাঝকা করেন, বনিও সেভাবেই ছোটো ছোটো শিশু গাছেদের বকাঝকা করে, শাসন করে, মাঝে মাঝে আদর যত্নে খাওয়া দাওয়ায়। খাওয়ানো দাওয়ানো মানে সার জল দেওয়া। আমাদের কাছ থেকেই সে দেখে দেখে শিখেছে। কখনো কখনো গাছেরা তার ছাত্র হয়ে যায়। বনি তখন স্কুলের দিদিমণি, সে গাছেদের অঙ্ক শেখায়, অ আ ক খ ইত্যাদি শেখয়, A B C D শেখায়।

 সে খুব ভালো দিদিমণি, ছাত্রছাত্রীদের শাস্তি দেয় না,আদর করে বুঝিয়ে শুঝিয়ে শেখায়।   অন্য সময় গাছেরা বনির 
বন্ধু, তখন তাদের নাম পালটে যায়, তাদের নামের জায়গায় যুক্ত হয় বনির স্কুলের বন্ধুদের নাম, কখনো কখনো আমাদের পারিবারিক বা অন্য পরিচিত কোনো কোনো ছেলেমেয়েদের নামও গাছেদের উপর আরোপিত হয়। আমাদের সঙ্গে সময় কাটানোর বাইরে তার বেশিরভাগ সময় কাটে কোয়ার্টারের বাগানে । বাগানে এভাবে একা একা ঘুরে বেড়ানোতে যদিও বনির মা-এর মৃদু আপত্তি, কিন্তু বনির কোনো খেলার সাথি নেই বলে মেনে নিয়েছেন তিনি। বাগানের ঝাউগাছের কোঠরে বাসা করে থাকে দুটো কাঠবিড়ালি। তারা মাঝে মাঝে বাগানের ঘাসে নেমে আসে, ঘুরে বেড়ায়। তারাও বনির বন্ধু, তাদের কোনো একটিকে দেখতে পেলেই, বনি সদ্য সদ্য শেখা নজরুল ইসলামের 'খুকু ও কাঠবেড়ালী' কবিতার প্রথম লাইনকটি বলতে থাকে-  "কাঠবেড়ালী কাঠবেড়ালী  পেয়ারা তুমি খাও!গুড় - মুড়ি খাও? দুধ- ভাত খাও?" বাগানে যে 
ক-টিপাখি মাঝে মাঝে আসে, তাদের সঙ্গেও বনির ভাব হয়ে গেছে। যদিও তারা বনির হাতের নাগালে আসে না, কিন্তু  বনিকে মোটেই ভয় পায় না। তারা হল বনির একটু দূরের বন্ধু । 
  একবার এক রাতের প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে বাগানখানা তছনছ হয়ে গেল। হওয়ায় লতানো গাছগুলি পড়ল মাটিতে লুটিয়ে। দুর্বল মৌসুমি ফুলের গাছের পাতা, ফুল এলোমেলো হয়ে, ডালপালা ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাগানের দুর্দশা দেখে বনির সে কি কান্না। শেষে একটি লোক ডেকে, বাগানটাকে পরিষ্কার করে, লুটিয়ে পড়া গাছগুলো মাটি থেকে তুলে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তবে তাকে কিছুটা শান্ত করা গেল। এই বাগানকে নিয়েই তার যত ভাবনা, এটাই তার খেলার জগৎ। 


     পাশের কোয়ার্টার থেকে একটি বেড়াল প্রায়ই বাগানে ঢুকে অপকর্ম করে যেত, কখনো-বা  অপকর্ম মাটিচাপা দিয়ে রাখত। বনির তো বাগানে অবাধ বিচরণ, কখনো কখনো অপকর্ম মাড়িয়ে ফেলে তার সে কী কান্না। কাঁদতে কাঁদতে সে আমাকে বলে, "বাবা তুমি ওই দুষ্টু বেড়ালটাকে  তাড়িয়ে দাও, নইলে আমার বাগানে বেড়া দিয়ে দাও যাতে বেড়ালটা কখনো ঢুকতে না -পারে।" বাগানটাকে নিয়ে তার এরকম নানা আবদার আর নানা বায়না।    
   শীতকালে যখন বাগানে নানা রঙের নানা রকমের ফুল ফোটে, কত প্রজাতি উড়ে আসে। বনির তখন আনন্দ আর ধরে না। সে সারাক্ষণ
প্রজাপতির পিছুপিছু ছুটে বেড়ায়। পূজার আগে আগে বাগনের ঘাসের রং বেশ ঘন সবুজ হয়ে ওঠে, তখন ঘাসফুলে লাল, হলদে ছাই রঙের কত ফড়িং এসে বসে। টুকটুকে লাল রঙের ফড়িংটি বনির খুব পছন্দ, মাঝে মাঝে সেটিকে সে ধরতে চায়। তার পিছে ছুটে ছুটে নিরাশ হয়ে থামে। 
     একবার উঁচু কোনো গাছ থেকে হাওয়ায় একটি ছোট্টো পাখির ছানা বাগানের ঘাসে এসে পড়েছিল। খুবই ছোটো ছানাটি, গায়ে পালক গজিয়েছে বটে কিন্তু উড়তে শেখেনি। 
মা -বাবা পাখিরা দূরে ঝোপের কোণ থেকে ডাকাডাকি করছে ভয়ে ভয়ে। বনি তো খুব খুশি, সে পাখির ছানাটিকে হাতে নিতে চায়, গায়ে হাত বুলোতে চায়। তারপর বনির বায়না, একটি বাসা বানিয়ে সে পাখির ছানাটিকে পুষবে । অনেক চেষ্টা করেও তাকে বোঝানো গেল না এত ছোটো পাখি পোষা যায় না। বরং ছানাটিকে এখন ওর বাবা মায়ের কাছে রেখে এলে সে যখন বড়ো হবে নিজেই তখন বাগানে এসে খেলবে এবং বনির বন্ধু হবে। আমি যতবার বলি 'ওই দেখ, ওর মা -বাবা কেমন কান্নাকাটি করছে।'


কিছুতেই তকে বোঝানো গেল না। সত্যিই বাগানে তখনো মা বাবা পাখিরা তারস্বরে ডেকেই চলেছে। আর আমরাও চিন্তিত এতটুকু পাখির ছানা সত্যই পোষা যাবে তো? 
কিন্তু কিছুতেই বনিকে নিবৃত্ত করা গেল না। বাধ্য হয়ে আমাকে একটা লোহার পাখির খাঁচা কিনে এনে পাখির ছানাটিকে পোষার ব্যবস্থা করে দিতে হল। 
বনির সে কি আনন্দ!
এবার বায়না শুরু হ, "বাবা, বাগান থেকে পোকা ধরে এনে দাও, পাখিটিকে খাওয়াব, ওর খিদে পেয়েছে।বাবা জল নিয়ে এসো ও জল খাবে।' আমারতো নাজেহাল অবস্থা, পাখিরছানাটিরও তাই। বেচারা এমনিতেই ভয়ে ভয়ে আছে, তার ওপর বনির এত আদর যত্নের ঠেলায় ওরও প্রাণ ওষ্ঠাগত। বনির মা তো রেগেমেগে আমাকেই একহাত নিচ্ছেন, 'তোমার যত আদিখ্যেতা, মেয়ের সব বায়না কি মেনে নিতেই হবে? আমি কিচ্ছু জানি না, এবার সবকিছু তোমাকেই সামলাতে হবে।' সে যাক, সব সামলে নিয়ে ছানাটিকে তো খাঁচায় রাখা হল , তার প্রাণচাঞ্চল্য কিছু নেই, মনমরা হয়ে থাকছে, দু-এক ঠোক্কর খেলেও বেশিরভাগ সময় চুপচাপ গুটিয়ে রাখছে নিজেকে। বনি ওকে চাঙ্গা করার যত চেষ্টা করছে ও তত ঝিমিয়ে পড়ছে। 


    এরইমধ্যে বনির মাকে গান শেখার জন্য কলকাতায় যেতে হল দুদিনের জন্য। মা নেই তাই বনিরও মনখারাপ। বাগানে যাচ্ছে না, পাখিটির জন্যও খুব মাতামাতি নেই। পাখিটাকে খাওয়াতে গিয়ে দেখে ওর খাওয়ার ইচ্ছে নেই। 
বনি হয়তো বুঝতে পেরেছে পাখিটিরও মনখারাপ ওর মা-এর জন্য। তখন সে মুখ কালো করে আমার লেখার টেবিলের কাছে এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। আমি পিঠে হাত রেখে একটু আদর করে বললাম, 'কি হল মা তোমার?' সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, 'বাবা ওকে ছেড়ে দাও।' আমি বললাম, 'কাকে?' ' এবার বনি কেঁদেই ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,  'আমার যেমন আজ মা-এর জন্য মনখারাপ, ওরও
তাই, তুমি ওকে ওর মা-এর কাছে রেখে দিয়ে আসো বাবা।' 
   তারপর আমার যা করণীয়, খাঁচা খুলে পাখির ছানাটাকে ওর মা-এর কাছে বাগানে বোগেনভিলিয়ার ঝোপে রেখে এলাম ।

Comments :0

Login to leave a comment