মুক্তধারা
গল্প
বিচ্ছেদ
হিন্দোল মিত্র
সেদিন নবীনবরণ, বিমান কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। তাই নবীনবরণে দায়িত্ব নিশ্চিদভাবেই তার উপরেও পরেছে। বিমানের বন্ধুরা নবগত ছাত্র-ছাত্রীদের বরনে ব্যস্ত তার জন্যে নানা ধরনের অনুষ্ঠান চলছে। সবার পারফর্মেন্স শেষ হয়ে যাবার পর অবশেষে ডাক আসে বিমানের। বিমান অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছেলে। চট করে সবার সামনে নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করতে চায় না। তাছাড়া বিমানকে দেখলে মনে হয় সে খুব সাদামাটা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাকেই সবাই হেয়জ্ঞান করে। কিন্তু এত কিছুর পরেও বিমানের মধ্যে একটা সুন্দুর মন বর্তমান। যে মনে কোন পাপ নেই। যে মন ঝর্ণার মত স্বচ্ছ। পূর্ব কথা অনুযায়ী বিমানের একটা খুব মস্ত ভুল সে খুব ভাল গান গাইতে পারে।বিমানের কাছে যখন গান গাইবার ডাক এল, তখন বিমান স্বভাবসিদ্ধভঙ্গিনী সংকুচিত হয়ে পড়ল। অথচ না গেয়েও উপায় নেই। তাই সাময়িক দোটানার পরে অবশেষে বিমান গান গাইল। এবং তার গান শেষহবার সঙ্গে সঙ্গেই সব শ্রোতার মন জয় করে নিল। করতালিতে হল ভরে উঠল। নবীনবরণ উৎসব শেষ। বিমান বাড়ী ফিরছে হঠাতই কলেজে সদ্য ভর্তি হওয়া একটি মেয়ে বিমানের দিকে এগিয়ে এল"বিমান দা (গান গাওয়ার সময়ই সে বিমানের নাম শুনেছে) আমারএক বান্ধবী আপনার সাথে আলাপ করতে চায়।”মেয়েদির কথায় বিমান যারপরনাই আশ্চর্য হল। একই সঙ্গে লজ্জাও পেল। কারণটা খুবই স্পষ্ট। প্রথমত তার সঙ্গে কোনদিন কোন মেয়ে জেচে আলাপ করতে আসে নি। দ্বিতীয়ত- বিমানের স্বভাব অনুযায়ী কোন মেয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে চাইবে তাতে তার লজ্জা পাবারই কথা। অবশেষে মানসিক দ্বিধা কাটিয়ে সে বলল
-- "মেয়েটি কে?”
“এই যে আমার বন্ধু কাকলী।”মেয়েটির দিকে একবার চেয়ে বিমানের চোখ আটকে গেল। অপরূপ সুন্দরী বললেও কম বলা হয়। অনেকক্ষন মেয়েটির দিকে চেয়ে রইল বিমান। বিমানের চাউনি দেখে কাকলী লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে আস্তে আস্তেবলল
-"ওভাবে তাকাবেন না আমার লজ্জা করে!"
কাকলীর কথায় বিমানের চেতনা ফিরে আসে। করে ফেলা নির্লজ্জতায় নিজের উপর বিরক্ত হয় বিমান। পরক্ষনেই সে বলে
--"কি দরকার তোমার আমার সঙ্গে?”
"না মানে আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।"
আমতা আমতা করে বলল মেয়েটি।
মেয়েটির কথায় এবার বিপদে পরে গেল বিমান। তার মনে হল- 'একটি অচেনা-অজানা মেয়ের সঙ্গে হুট করে আলাপ করাটা কি সমিচিন! যদি হিতে বিপরিত হয়'
কাকলী বিমানের মনের কথা বুঝতে পারল।
"আপনি কোন চিন্তা করবেন না বিমান দা। আমাদের সম্পর্কটা শুধুই
বন্ধুত্বের হবে কেমন?"
তার কথায় কিছুটা স্বস্তি পেল বিমান।
"ঠিক আছে তুমি যখন বলছ তাহলে তাই হোক।"
বিমান ও কাকলীর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল।
এই ঘটনার পর বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে। বন্ধুত্বের বাঁধন ভেঙে বিমান ও কাকলীর সম্পর্কটা ক্রমেই প্রেমের বাঁধনে বাঁধা পরছে। কারণটা স্পষ্ট বিমানের মনের স্বচ্ছ নিশপাপ দিকটা কাকলীকে সামান্য হলেও আকর্ষিত করেছে। আর বিমান শুধু মাত্র কাকলীর সৌন্দর্য্য দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয় নি। হয়েছে তার মিষ্টি ব্যবহার দেখেও। এতকিছুর পরেও কাকলীর মন বিমানের উপর থেকে সরে যায়। কেন? এবার সেই প্রসঙ্গেই আসা যাক।কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ত মানস মানস কর। এক নম্বরের নারীললুপ ছিল সে। কাকলীর প্রতি তার অনেক দিনের নজর ছিল। বিমান ও কাকলীর সম্পর্কের ব্যাপারটা জানত মানস। তাই সে কাকলীর মন থেকে বিমান কে সরিয়ে দেবার ফাঁদ পাতে তারই বন্ধু অলোকেশ কে দিয়ে। বলা হয় মেয়েরা যত সুন্দরী হয় ততই তাদের বুদ্ধি তত কম হয়। তাই কলেজের একটা সামান্য ঝগড়ার ঘটনায় অলোকেশ সহজেই কাকলীর মনে বিমানের প্রতি বিষ ঢুকিয়ে দেয়। আসলে বিমান ছিল বামপন্থী কর্মী। মানস ও অলোকেশ ছিল দক্ষিণপন্থী। দুই দলের দ্বন্দের মূল কারণ হিসাবে অলোকেশ কাকলীর কাছে বিমানকেই দায়ী করে। কাকলী বিমানকে ত্যাগ করে। মানসের সঙ্গে কাকলীর সম্পর্ক গড়ে উঠলেও কাকলী অচিরাৎ মানসকে চিন্তে পেরে যায়। কারণবশতঃ প্রবল অপরাদবোধ নিয়ে কাকলী বিমানের সাথে দেখা করতে যায়। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই বিমান বলে
--"কেন এসেছো কাকলী?"
তার কথা শুনে আহত কণ্ঠে কাকলী বলে
"ওভাবে বল না বিমান - "
তার কথা শেষ হবার আগেই বিমান বলে
"তুমি চলে যাও এখান থেকে। আমি তোমার সঙ্গে কোন কথা বলতে চাই না।"
কথাটা বিমান এমনভাবে বলল যে তার জবাবে কাকলীর আর কিছুই বলার রইল না।
আস্তে আস্তে কাকলী বিমানের বাড়ী থেকে চলে এল তাদের বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে।
Comments :0