Post Editorial Ukraine war

ইউক্রেন যুদ্ধে ছেঁড়াখোরা পৃথিবী

সম্পাদকীয় বিভাগ

Post Editorial

সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকে নাকি পাক্কা খবর ছিল মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে। খবর ছিল রাশিয়া এ যুদ্ধ বেশিদিন চালাতে পারবে না। নানান ফরমানের অবরোধে মুখ থুবড়ে পড়বে। খবর ছিল প্রাসাদ চক্রান্তে পুতিনের জমানা শেষ হলো বলে।

 

 

 যদিও যুদ্ধ চলছে ৯ মাস ধরে। পুতিন জারের ঝান্ডা লাগিয়ে দিব্যি ক্ষমতায় বহাল।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের নির্বাচিত সরকার ফেলে দিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রুশ জনসাধারণের ওপর চলানো নয়া ফ্যাসিস্তদের হামলায় চৌদ্দ হাজার মানুষ খুন হয়েছেন। আর ৯ মাসের যুদ্ধে বিপর্যস্ত ইউক্রেনে কত যে নিরপরাধ মানুষ খুন এবং আহত হয়েছেন তার কোনও শেষ নেই। অবশ্য এতে যারা যুদ্ধের উসকানি দিলেন তাদের কিছু এসে যায় না। কিন্তু এ যুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনীতিতে ৫০ বিলিয়ন পাউন্ডের চওড়া ফাটল তৈরি হয়েছে। কি দিয়ে ভরাট করবেন তার মাপজোক করতে গিয়ে এই নিয়ে দুটি মন্ত্রীসভা ঐ গর্ত দিয়ে গলে গেছে। তিন নম্বরী প্রধানমন্ত্রী সুনক, ধান্দাপুঁজির বাধ্য ছেলে। হিসাব সামলাতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিডেনের মাথা গরম হয়ে গেছে। ইউক্রেনের প্রধান জেলেনস্কির সাথে কথা বলতে গিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে ফেলেছেন — আর কত চাই? আর কত দেব? কারণ জেলেনস্কি কথার শুরুতেই নাকি হিসাব ফেলেছেন।

 

 

 কত কি পাবার ছিল আমেরিকার কাছ থেকে, কত কি পাননি —
বিশ্ববিখ্যাত ইতালির নাট্যকার-পরিচালক-অভিনেতা দারিও ফো একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক করেছিলেন ‘‘নব সি পাগা! নন সি পাগা!’’ সাদা বাংলায় ‘‘পকেটে নেই কিছু, দেবোও না’’। ইংরেজিতে “Can’t pay : Won’t pay” মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্মিত এই নাটক ৩৫টি দেশে অভিনীত হয়। সারা ইউক্রেনের খেটে খাওয়া মানুষকে এই পথেই হাঁটতে হচ্ছে, রাস্তায়-মিছিলে তার উদ্ধত প্রকাশ। ফ্রান্স-ইংল্যান্ড-গ্রিস-স্পেন-বেলজিয়াম সর্বত্র শুরু হয়েছে হরতাল। পালটা লড়াইতে না নামলে শিয়রে শনি নামছে। বড়লোকদের ভাষায় এসব ‘ছোটোলোকদের’ হিসাবটা কিরকম?
শীত এসে গেছে। 

 

 

ইউরোপের সুপর্ণাদের বাড়িতে দিন আনি দিন খাই হেঁশেলে রান্নার গ্যাস নেই। এ পর্যন্ত আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু অনেক কিছু আছে, শুধু কি রান্নাঘর। অজস্র কলকারখানা যা গ্যাস এবং তেলে চলে সব এখন চলবে কি করে? জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি চলবে কি করে? এখন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কয়লার ব্যবহার করা হয় কম, বাতাসে যাতে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ না হয় তার জন্য। অতঃকিম? বিদ্যুৎ না এলে অন্যতম প্রধান পরিবহণ রেল চলবে কি করে? এই সামান্য অকল্যাণের হিসাবে রেল-বিদ্যুৎ-ইস্পাত-খনি শুধু এই চারটি শিল্পে জড়িত ইউরোপের লক্ষ লক্ষ পরিবার বেরোজগারির মুখে পড়তে চলেছে। কে দেখবে? সরকার? সরকারের তেল ও গ্যাসের দাম বাড়াতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। কারণ রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবাদের জনস্রোত।

 

 


এবার বাজারের চলতি কিছু ঝাড়ফুঁক কথাবার্তার দিকে তাকানো যাক। তথাকথিত উচ্চমেধার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেরও অবস্থা কাহিল। কারণ এক্ষেত্রে প্রয়োজন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় হাই-ফ্রিকোয়েন্সি বা উচ্চক্ষমতার তরঙ্গ বিদ্যুৎ, এখন যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিই সচল হয়ে পড়ে তাহলে কি হবে? এবার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এই সঙ্কট ঝাঁপিয়ে পড়বে সেখানে তা হলো ইন্টারনেট-অনলাইন নির্ভর শেয়ার বাজার। যা কার্যত আজকের বিশ্ব পুঁজিবাদের অন্যতম সেরা মুনাফা কমানোর জায়গা। লকডাউনের সময় যখন গোটা ভারতবর্ষ অচল হয়ে গিয়েছিল তখন সবথেকে সচল ছিল শেয়ার বাজার। খেটে খাওয়া মানুষ পথের ভিখারি হয়েছেন আর এদেশের লক্ষ কোটিপতিরা বিলাসমহলে আরও ফুলেফেঁপে ঢোঁল হয়েছে। কারণ ঐ পুঁজির সফল কারবার। সারা পৃথিবীতেই ছিল এক ছবি। ইউরোপে অবশ্য মেহনতি মানুষকে ভারতবর্ষের মতো হ্যাঁপা সইতে হয়নি। কারণ ওদেশের সরকার করোনা আক্রান্তর সময়ে রুজিরোজগারবিহীন মানুষকে বেশ ভালোরকম আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। অমৃতমহোৎসবের চুল-দাড়ি ভেজানো মোদীজীর মতো নির্বিকার ভুখমিছিল দেখার কাজ করেনি। নানান পোজের ফটোসেশন ছিল না।

 

 


দিশাহারা অবস্থা হয়েছে নয়া সাম্রাজ্যবাদের মাতব্বর আমেরিকার। তার যন্তরমন্তরের কথামতো সবাই চলছে না। পরম দোস্তরাও দূরত্ব বাড়াচ্ছেন। যেমন সৌদি আরব। ওয়াশিংটন প্রভুরা নিদান হেঁকেছিলেন অশোধিত খনিজ তেলের দাম কমাতে হবে। ওপেক, যারা তেল সাম্রাজ্যের বেতিম বাদশা তারা রাশিয়ার সাথে কথা বলে তেলের উৎপাদনটাই কমিয়ে দিল। আমেরিকা এখানে অর্থনীতির তত্ত্বে কিছু ভুল পাচ্ছে না সে বোঝাবে। কারণ এ রাস্তায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়বে না। পোয়াবারো রাশিয়ার। সে তেল জুগিয়ে ভালো কামাবে। ইতিমধ্যেই তথ্য বলছে এতো নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের বহু দেশ রাশিয়া থেকে তেল নিয়েই চলেছে। এসব কারবারে আমেরিকার ছক গুলিয়ে গেছে।

 

 

 কারণ সে ভেবেছিল চাপ তৈরি করে, রাশিয়াকে কোণঠাসা করে তেলের দাম কমিয়ে নির্বাচনে ফায়দা তুলবে। হলো ঠিক উলটো। কেউই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জায়গায় নেই। রিপাবলিকান এবং ডেমেক্র্যাট উভয়ই প্রায় সমান সমান।
ফাঁপড়ে পড়ে গেছে নয়াদিল্লি, কারণ রাশিয়ার তেলের সব থেকে বড় খদ্দের হলো চীন এবং ভারতবর্ষ। ভারত প্রথম থেকেই তেল কিনছে ডলারে। এতে আমেরিকা চোখ বুজে ছিল, কারণ এ দুনিয়ায় যত বেশি ডলারের লেনদেন হবে তত তার বেশি লাভ। ডলার শক্তিশালী হবে। প্রথম থেকেই রাশিয়া বলেছিল তার দেশের মুদ্রা রুবলে কারবার করতে। কিন্তু শোনেনি ভারত।
অবস্থাটা বদলে গেল আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের একটি সিদ্ধান্তে। তারা জমা টাকার ওপর সুদ বাড়ালো। যেই না বাড়ানো হলো, তামাম দুনিয়ার পুঁজির কারবারিরা সেখানে গেল ডলারে সম্পদ খাটাতে। তাতে লাভ বেশি। এক্ষেত্রে ঝাড়ফুঁক বিশ্বাস হচ্ছে এ দুনিয়ায় ডলারে খাটানো মানে নাকি সোনা গচ্ছিত রাখার মতো। গেরোয় পরে গেছে নির্মলা সীতারমন। কারণ আমেরিকা সুদের হার বাড়িয়েছে কারণ মুদ্রাস্ফীতি। ভারত সরকারও সুদের হার বাড়িয়েছে কারণ মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে কারণ তেল ও গ্যাসের বাজার চড়া। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অনেক কৃষিপণ্যও বাজারে আসছে না বিশেষ করে গম। আটা-রুটি সবকিছুর দাম চড়ছে চড়চড় করে। এসবের ফলে ভারতবর্ষের টাকার দাম ডলারের তুলনায় দ্রুত পড়ছে। বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ার ক্রমশ খালি হয়ে যাচ্ছে। বিদেশি মুদ্রা যাদের ছিল তারা সব তুলে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে আমেরিকার শেয়ার বাজারে। অবস্থা সামাল দিতে এখন যখন ভারত সরকার রাশিয়াকে বলছে যে আমরা রাশিয়ান রুবলে বিনিময় করতে চাই। কারণ এতে ভারতের লাভ। রুবল আর টাকার মধ্যে ফারাক খুবই কম। রাশিয়া কোনও উচ্চবাচ্যই করছে না। এখানেও কারণ আছে। রুবল এখন ডলারের তুলনায় ক্রমেই শক্তি অর্জন করছে। তাহলে এরকম করছে কেন? বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর তো হরবখৎ বলে যাচ্ছেন যে রাশিয়া আমাদের দীর্ঘদিনের মিত্র। তবে?
কারণ হলো রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা। যাতে ইউক্রেন যুদ্ধের আন্তর্জাতিক তর্কবিতর্কে ভারতবর্ষ না আবার রাশিয়ার বিপক্ষে হাত তুলে বসে। এখনও অবধি ভারতের মতামত রাশিয়ার বিপক্ষে নয়। আবার আফগান তালিবান সরকারের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরা যাতে ভারতে অস্থিরতা না তৈরি করে তার জন্য ভারতবর্ষের এখন আমেরিকার থেকে রাশিয়াকেই বেশি প্রয়োজন। রাষ্ট্রসঙ্ঘে রাশিয়ারও সঙ্গী দেশ প্রয়োজন। 

 

 

নিঃসন্দেহে এসময়ে ইউরোপের মন্দার তালিকায় ঢুকে যাওয়া দেশের সংখ্যা ১৯। এই উনিশটি দেশের সবাই সে রাশিয়ার বিপক্ষে আদৌ তা নয়। কিন্তু রাশিয়া এখন ইউরোপের বাইরে বহু দেশের সমর্থন পেয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের সপক্ষে নয় কিন্তু এ যুদ্ধের আগুন জ্বালাবার কলকাঠির বিরুদ্ধে।
কলকাঠিরাও আতান্তরে পড়েছে। কিরকম? ধরুন ন্যাটো, অন্যতম পালের গোদা, যদি ইউক্রেন ন্যাটো জোটে নাম লেখাতো তাহলে চুক্তি অনুযায়ী ন্যাটো রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করতো, হয়তো, কিন্তু ইউক্রেন ন্যাটোতে সই করেনি। ফলত তলায় তলায় সমর্থন। রাশিয়া ঠিক এটাই সতর্ক করেছিল। ইউক্রেন ন্যাটো জোটভুক্ত হওয়া মানেই রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর সৈন্য মোতায়েন। রাশিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার ব্যাপারটা ইউরোপের সব দেশই জানে। কিন্তু রাশিয়ার মতলবও খুব সুবিধার নয়। ছলেবলে কৌশলে পুরানো জারের সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। তাই কেউ এক জায়গায় নেই। পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক ডামাডোল নিজেদের ভিতরেই রাজনৈতিক চরম অস্তিরতার দম দিচ্ছে।
করোনাকালের আগে থেকে আজ পর্যন্ত ক্রমশ পুঁজিবাদী দুনিয়া এক বিকট মন্দার গ্রাসে গিয়ে পড়ছে। তাই সমস্ত অভিমুখগুলিই ইউরো‍‌পে নয়া ফ্যাসিস্ত দলগুলিকে পোক্ত করার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একটার পর একটা দেশের নির্বাচনে জয়লাভ করছে কট্টর দক্ষিণপন্থী নয়া ফ্যাসিস্ত দলগুলি। ইতালি যার সর্বশেষ উদাহরণ। ২০১৮ সালে যে ব্রাদার্স পার্টি মাত্র ৪% ভোট পেয়েছিল, তারাই এখন ২৬% ভোট পেয়ে সরকার চালাচ্ছে।
মন্দার বাজারে একজন এক কোটিপতির কয়েক কোটি টাকা খসে গেলে মিডিয়া জুড়ে হই চই শুরু হয়ে যায়। আর যদি কয়েক লক্ষ খেটে খাওয়া মানুষ ফতুর হয়ে যায় তাহলে যে অন্যস্বর তৈরি হয় তাকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করছে এইসব দক্ষিণপন্থী দলগুলি। যারা অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে মুখোশ এঁটে গোপনে তাদেরই পীরবাবাদের মন্ত্রশিষ্য হিসাবে কাজ করে। আজকের ইউরোপে কমিউনিস্ট-বামশক্তি যথেষ্ট দুর্বল। এই দুর্বলতাই একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তির আওয়াজ তোলার বদলে একটার পর একটা নতুন সমস্যায় মানুষকে জেরবার করে দিচ্ছে।

 

 

 


এরকম অবস্থায় পুঁজির মুনাফা কামাবার রাস্তা কিন্তু যুদ্ধ। যুদ্ধ তার অর্থনীতিকে তৈরি রাখবে। অস্ত্র কোম্পানিগুলোর পোয়াবারো। আর নানারকম যুদ্ধ চালাতে গেলে সরকারে নয়া ফ্যাসিস্ত যুদ্ধবাজ দলগুলিই প্রয়োজন। কিন্তু একটা মস্তবড় কিন্তু আছে। আফগানিস্তানকে বোমা মেরে ছাঁতু করে তালিবানদের বসিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ইউরোপ জানে দুটো বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস। সেই ক্ষত বুকে নিয়ে পথহাঁটা আজকের প্রজন্ম এ যুদ্ধের বিরুদ্ধে যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলেই দাড়ি কমা শুদ্ধু নয়া সাম্রাজ্যবাদ পিছু হটবে। আর খতম হবে সেদিন, যেদিন কমিউনিজমের পুনরুত্থান ঘটবে। 

Comments :0

Login to leave a comment