Aleida Guevara Post Editorial Ganashakti

কিউবার পাশে বাংলা, চে-তনয়াকে তাই স্বাগত

সম্পাদকীয় বিভাগ

Aleida Guevara Post Editorial Ganashakti


চে-তনয়া ডাঃ অ্যালেইদা গুয়েভারার কলকাতায় আসছেন। শুধু কলকাতাতেই নয়, গত ৪ জানুয়ারি কেরালা থেকে শুরু হয়েছে তাঁর ভারত সফর। এবারে এসেছেন মেয়েকে নিয়ে-এস্তেফানিয়া মাচিন গুয়েভারা। তেইশ দিনের ভারত সফরের বেশির ভাগ সময়েই কাটছে কিউবার প্রতি সংহতি জ্ঞাপক নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে। কেরালা ছাড়াও কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি’তেও তিনি যাচ্ছেন। কলকাতায় থাকছেন ২০-২১ জানুয়ারি।

এ শহরে এর আগে এসেছিলেন ১৯৯৭ সালের শেষ দিকে। তারপর দেশের অন্যত্র এলেও এখানে আসা হয়নি। প্রায় পঁচিশ বছর পর আবার তিনি কলকাতায়। সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থা (এআইপিএসও), ন্যাশনাল কমিটি ফর সলিডারিটি উইথ কিউবা (এনসিএসসি) সহ বিভিন্ন গণসংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, শিক্ষক  সংগঠন, ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠন, ব্যাঙ্ক-বিমা কর্মী, মধ্যবিত্ত কর্মচারী সংগঠন, বহুবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা এগিয়ে এসেছে এই কর্মসূচি সফল করতে। এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। নবীন ও প্রবীণ গীতিকার, সুরকার, গায়করা ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। নতুন লেখা গানের সুর ভাঁজার কাজ চলছে। কানে এল। দু’দিনের সফরেও বাড়ন্ত সময়। আরও কটা দিন যদি তাঁরা থাকবেন! কিউবার প্রতি ভালোবাসা আর সংহতিতে আগ্রহ এবং আবেগের উষ্ণতা। শান্তি ও সংহতি আন্দোলনে নতুন মাত্রা।


কলকাতা এমনই। শুরু হয়েছিল রামমোহন রায়কে দিয়ে। সাইমন বলিভারের সাফল্য তিনি উদ্‌যাপন করেছিল আজ থেকে ২০০ বছর আগে। চীনে আফিমের ব্যবসা কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসা নিয়ে  নিয়ে তরুণ রবীন্দ্রনাথের ক্ষোভের মধ্যে নিহিত ছিল নতুন যুগের হৃদস্পন্দন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামের বিস্তার, ১৯১৭-র অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক গণউদ্যোগের প্রভাব আমাদের চেতনাভূমিকে প্রসারিত  করে আন্তর্জাতিকতাবাদের আধুনিকতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী আবিশ্ব আলোড়ন— বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রতিষ্ঠা— পরাধীনতার পর্বেই সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থা গঠনের ভিত্তি রচনা।

কিউবাই লাতিন আমেরিকায় প্রথম মার্কিন নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদের পুতুল স্বৈরাশাসককে পরাস্ত করে সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের ভিত্তি রচনা করে। বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্ব থেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল ওয়াশিংটন। মার্কিন ভূখণ্ড থেকে মাত্র নব্বই মাইল দূরে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে শায়েস্তা করতে হেন ষড়যন্ত্র নেই আমেরিকা করেনি। অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক অবরোধের ফাঁদ বছরের পর বছর শক্ত হয়েছে। কার্যত তা এখন বাস্তবিকভাবেই অর্থনৈতিক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। 
বিপ্লবের কিছু দিনের মধ্যেই হাভানার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ওয়াশিংটন। ২০১৫ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার আমলে কূটনৈতিক সম্পর্কে পুনঃস্থাপিত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমল থেকে পরিস্থিতির অবনতি ধারাবাহিক রূপ নিয়েছে।

আমেরিকা চেয়েছিল কিউবাকে একঘরে করতে, কিন্তু তথাকথিত সমাজতন্ত্র-উত্তর পর্বেই লাতিন আমেরিকায় একের পর এক দেশে রাজনৈতিক পালাবদল এবং বাম-ঘেঁসা রাজনৈতিক জোটের সরকার গঠন, কার্যত আমেরিকাকেই একঘরে করে দেয় দক্ষিণ আমেরিকা।
১৯৯০-র দশকে কিউবা সংহতি আন্দোলন অনেকটা ১৯৬০-র দশকের ভিয়েতনাম সংহতি সমাজতন্ত্রের জুড়ে। তার আগে ১৯৮০-র দশক জুড়ে মধ্য আমেরিকার দেশ নিকারাগুয়ার প্রতি সংহতি জানিয়ে গণতৎপরতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৬০-র দশকে ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলনের পাশাপাশি কিউবা সংহতি আন্দোলনও মাথা তোলে। সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে কেন্দ্র করে গণসংহতি আন্দোলনের ক্রমবিস্তার বিশেষ মাত্রা পায় সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের, বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রেক্ষাপটে। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় পরবর্তী কঠিন পরিস্থিতিতে বারবার সমাজতান্ত্রিক কিউবার পাশে দাঁড়িয়েছেন বাংলার মানুষ ।  

তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে সভাপতি করে ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল এরাজ্যে গঠিত হয়েছিল ‘কিউবা সংহতি কমিটি’। তার কয়েক মাস আগে দিল্লিতে গঠিত হয় জাতীয় স্তরের সংহতি কমিটি। সে সময় কিউবার জন্য খাদ্য সামগ্রী ও অন্যান্য সাহায্য জাহাজে করে কিউবা পাঠানো হয় হলদিয়া বন্দর থেকে ১৯৯২ সালের ১ অক্টোবর।। রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো নিজে উপস্থিত থেকে সেইসব সামগ্রী আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। কলকাতাতেই ১৯৯৫ সালের ২২-২৪ সেপ্টেম্বর  প্রথম এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক কিউবা সংহতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তারপর করোনা মহামারীর আগে পর্যন্ত এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক কিউবা সংহতি সম্মেলন এআইপিএসও পশ্চিমবঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কিউবার সমর্থনে  লাগাতার নানা কর্মসূচি পালন করে চলেছে। প্রতি বছর ২৬ জুলাই কলকাতায় পালিত হয় ‘মনকাডা দিবস’ ।


এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো কলকাতায় প্রথম পা রেখেছিলেন ১৯৭৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ভিয়েতনাম সফর সেরে ফেরার পথে কিউবার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি দমদম বিমান বন্দরে যাত্রাবিরতি ঘটালে বিমানবন্দরেই জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি ভট্টাচার্য প্রমুখ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব বিমান বন্দরে গিয়ে কাস্ত্রোকে সংবর্ধনা জানান।  তারও আগে ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে চে গুয়েভারা এসেছিলেন কলকাতায়—বরানগরে আইএসআই-এ। উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিসংখ্যান বিদ্যার প্রয়োগে ভারতের অভিজ্ঞতা বুঝতে। আগরপাড়া জুট মিলেও তিনি গিয়েছিলেন। সম্ভবত দুদিন তিনি এই শহরে ছিলেন।
নয়া উদারবাদের নেতিবাচক আবহে সাম্রাজ্যবাদী প্রচার যুদ্ধের মধ্যেও গত দু’দশকের মতো সময় জুড়ে কিউবা সংহতি আন্দোলনে ব্যাপকতর অংশের মানুষ যুক্ত হয়েছেন। বলা যেতে পারে, বিশ্ব জুড়ে দেড়শোর মতো দেশে প্রায় দু’হাজারের মতো কিউবা সংহতি কমিটি বা মঞ্চ রয়েছে। কোনও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত নয়। কিউবা সংহতি আন্দোলন মানুষের আন্দোলন। কিউবার জনগণ, কিউবার সরকার গণসংহতি আন্দোলনকে ভরসা করে।


কিউবা ছোট্ট দেশ হলেও পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগ্রামকে কিউবা সমর্থন জানিয়েছে। আমেরিকা দেশে দেশে সেনা পাঠায়। কিউবা পাঠায় চিকিৎসকদের দল। কিউবার শত শত চিকিৎসক ভিন দেশে পীড়িত মানুষের সেবায় নিযুক্ত। করোনা মহামারী পর্বেও আমেরিকা অর্থনৈতিক অবরোধ বিন্দুমাত্র শিথিল না করলেও, সঙ্কটকালে আমেরিকার করোনা-আক্রান্ত মানুষের জন্য সাহায্যের প্রস্তাব দিতে কিউবা দ্বিধা করেনি। ভয়ঙ্কর মহামারীর মোকাবিলায় কিউবার সাফল্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জনস্বার্থবাহী বৈশিষ্ট্যকে  তুলে ধরে।
তবুও আন্তর্জাতিক কূটনীতির সমস্ত রীতিনীতিকে উপেক্ষা করে কিউবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প  প্রশাসনের আগ্রসী নীতিই অনুসরণ করে চলেছে আমেরিকার ডেমোক্র্যাট রাষ্ট্রপতি বাইডেনের প্রশাসন। কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ প্রত্যাহারের দাবিতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে বছরের পর বছর প্রস্তাব গৃহীত হলেও ওয়াশিংটন তাতে কর্ণপাত করতে নারাজ।

সাম্রাজ্যবাদ জানে, কিউবা আয়তনে বা জনসংখ্যায় যতই সামান্য হোক সমাজতন্ত্রই বিকল্পের দিশা। শুধুমাত্র ভেনেজুয়েলা নয়, একুশ শতকে ‘ওয়াশিংটনী ঐকমত্য’-কে প্রত্যাখ্যান করে নয়া উদারবাদের বিকল্প নীতিকে অবলম্বন করছে লাতিন আমেরিকায় একের পর এক দেশ। কিউবার বিকল্প নীতির মানদণ্ড নির্ধারণ করে সমাজতান্ত্রিক কিউবা। সাম্রাজ্যবাদ প্রথমে ভেবেছিল ওয়াশিংটনের নাকের সামনে কিউবা টিকতে পারবে না। তারপরে তারা ভাবলো, সোভিয়েতের বিপর্যয়ের পর পতন অবশ্যম্ভাবী। ফিদেল বললেন, সমাজতন্ত্র অথবা মৃত্যু। তারা ভেবেছিল কিউবা টিকবে ফিদেলের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। তাও মিলছে না। বরং কিউবাকেই দৃষ্টান্ত মানছে লাতিন আমেরিকার একের পর এক দেশ।

ওয়াশিংটন তাই মরিয়া। কিউবার বিরুদ্ধে হুমকি বাড়ছে। অন্তর্ঘাতের চেষ্টা চলেছে বামঘেঁষা সরকারগুলিকে ফেলার। পেরু থেকে সরানো হয়েছে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে। ব্রাজিলে অতিদক্ষিণপন্থী বোলসোনারা সমর্থকরা ভোটে হারার পর মুসোলিনি বাহিনীর মতো গায়ের জোরে সংসদ ভবন দখল করতে গিয়েছিল। স্বার্থে আঘাত লাগলে সাম্রাজ্যবাদ সাংবিধানিক কাঠামোকেও রেয়াত করে না।
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শান্তি ও সংহতি আন্দোলনের গুরুত্ব আজ তাই অপরিসীম। কিউবা সংহতি আন্দোলন আজ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণআন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এক মানবিক বিশ্ব গড়ার গণঅভিযানে যা অপরিহার্য। দেশ গড়ারও।

ডাঃ অ্যালেইদা গুয়েভারা সেই মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলার আহ্বানেরই বার্তাবাহক। বাংলা তাই কিউবার পাশে। ভারতও। ভারতের আমআদমি।

Comments :0

Login to leave a comment