১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট বেলেঘাটার হায়দারি মঞ্জিল নামে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে বসে অনশন শুরু করেছিলেন গান্ধীজী। স্বাধীনতার কয়েকদিন আগে গোটা দেশ জ্বলছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুনে। কলকাতা সহ বাংলার অবস্থা ভয়ঙ্কর। সেই অশান্তি থামাতেই কলকাতা আসেন গান্ধীজী, এবং বেলেঘাটায় অনশন শুরু করেন।
টানা ২৬ দিন অনশন চালান গান্ধীজী। সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন গান্ধীজী। তার এই প্রচেষ্টার ফলেই স্তিমিত হয় দাঙ্গার আগুন। এরপর তিনি দিল্লি ফিরে যান। এটি ছিল গান্ধীজীর শেষ কলকাতা সফর। কারণ তার কয়েক সপ্তাহ পরেই আরএসএস সদস্য নাথুরাম গডসের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।
গান্ধীজীর এই প্রয়াসকে স্মরণ করতে ২০২২ সাল থেকে সুকান্ত মঞ্চ থেকে গান্ধীভবন অবধি পদযাত্রা করছে এআইপিএসও। সংগঠনের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক অঞ্জন বেরা জানিয়েছেন, বর্তমান সময়ে ফের একবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঠাসবুনোট নষ্ট করার চেষ্টা চলছে রাজনৈতিক ভাবে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে গান্ধীজীর প্রচেষ্টাকে ফিরে দেখা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই ধারাবাহিক ভাবে এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
রবিবার সকাল ১০টা নাগাদ সুকান্ত মঞ্চের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য পদযাত্রা শুরু হয়। পদযাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন রাজ্যের বর্ষীয়ান বামপন্থী নেতা বিমান বসু। পদযাত্রার শুরুর আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। কিশোর বাহিনীর সুকান্ত শাখা এবং মানবজমিন ব্যান্ডের সদস্যরা গান এবং নাচ পরিবেশন করেন। সংক্ষিপ্ত সভা হয়। সভা পরিচালনা করেন এআইপিএসও’র সর্বভারতীয় নেতা রবীন দেব। বক্তব্য রাখেন অঞ্জন বেরা প্রমুখ।
মিছিল কয়েক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গান্ধীভবনে পৌঁছয়। মিছিলে ট্যাবলো, নাটক, ইত্যাদির মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনাকে তুলে ধরা হয়। জাতীয় পতাকা হাতে কচিকাঁচারা পদযাত্রায় অংশ নেয়। মিছিলে বিমান বসু, প্রবীর দেব, রবীন দেব, অঞ্জন বেরা, উৎপল দত্ত সহ নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন। ছাত্র, যুব, মহিলা, শিক্ষক, অধ্যাপক এবং শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও এদিন উপস্থিত ছিলেন।
গান্ধীভবন পৌঁছে গান্ধীজীর মূর্তিতে মাল্যদান করেন বিমান বসু, মনোজ ভট্টাচার্য, প্রবীর দেব সহ রাজ্য বামফ্রন্টের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ। এরপর বেলেঘাটা মেন রোডের উপর সংক্ষিপ্ত সভা হয়। সেই সভা পরিচালনা করেন অশোক গুহ। বক্তব্য রাখেন গৌতম ঘোষ, জীবন সাহা, সমর চক্রবর্তী, প্রলয় চৌধুরী, সোমনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ।
প্রত্যেক বক্তা বর্তমান সময়ে আরও বেশি করে সংবিধান এবং তার ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক চেতনাকে আঁকড়ে ধরার বিষয়ে জোর দেন। তাঁদের বক্তব্যের নির্যাস, হিন্দুত্ববাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলি গান্ধীজীকে শত্রু চিহ্নিত করেছিল ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাঁর আপোষহীন অবস্থানের জন্য। দেশভাগ সমর্থন না করলেও, দেশভাগের ফলে তৈরি হওয়া পাকিস্তান যাতে তাঁদের প্রাপ্য সমস্ত আর্থিক সুবিধা পায়, সেই বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন গান্ধীজী। ধর্মের ভিত্তিতে দেশের বিভাজন হলেও, তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু মুসলমান পরিবার ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানের বদলে ভারতের সংবিধানকে আপন করে নেন।
দীর্ঘ ৭০-৭৫ বছর সেই বহুত্ববাদী চরিত্র বজায় থাকলেও, বর্তমানে সেটিকে রক্ষা করাই চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ প্রতিহত করতে সমস্ত অংশের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এমনটাই উঠে এসেছে এদিনের সভায়।
Comments :0