Editorial

জো হুজুর কমিশন

সম্পাদকীয় বিভাগ


আগামী  লোকসভা নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আরও একটি গুরুতর এবং গণতন্ত্রের উদ্বেগজনক পদক্ষেপ নিচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। আগামী লোকসভা নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত আইন বদল করে নতুন যে আইন আনা হচ্ছে, এতে প্রধানমন্ত্রী তথা শাসকদলের পছন্দের ব্যক্তিদের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার পদে  নিয়োগ করা হয়েছে। নতুন আইন প্রধানমন্ত্রী তথা আরএসএস-বিজেপি’র অপছন্দের, এমনকি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির কেউও  কমিশনার পদে বসার সুযোগ পাবেন না। আইন সংশোধন হয়েছে সেই  লক্ষ্য যাতে একমাত্র নরেন্দ্র মোদীর অনুগত ও পছন্দের লোকদেরকেই ঐ পদগুলিতে বসানো যায়। সব ঠিকঠাক চললে আগামী লোকসভা নির্বাচন হতে চলেছে মোদীর পছন্দের লোকজনদের পরিচালনায়।
কমিশনাররা যদি ব-কলমে শাসক কর্তৃপক্ষের অনুগত বা প্রতিনিধি হয়, তাহলে নির্বাচনে  সততার, স্বচ্ছতার এবং নিরপেক্ষতার কোনো বালাই থাকে না। সরকার ও শাসকদল যথেচ্ছভাবে বিধি লঙ্ঘন করলেও কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেবে না। এমনিতেই বিগত নির্বাচনগুলিতে  খোদ প্রধানমন্ত্রী একের পর এক বিধি লঙ্ঘন করে গেলেও, তাঁর বিরুদ্ধে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ জমা পড়লেও কমিশন টু-শব্দটিও  করেনি। এরপর নতুন আইনে কমিশনার নিয়োগ হলে নির্বাচন কমিশন  কার্যত আরএসএস-বিজেপি’র দলীয় শাখা অফিসে পরিণত হবে।
যে-কোনো স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে  তুলতে হলে সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়। জনগণের ভোটে যেহেতু সরকার নির্বাচিত হয়, তাই অবাধ, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্ভয়ে ও নিঃসংকোচে যাতে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হয়। তা নাহলে জনমতের সঠিক ও যথার্থ প্রতিফলন সম্ভব নয়। তাই যে সংস্থা নির্বাচন পরিচালনার নিরঙ্কুশ দায়িত্ব পালন করবে এবং জনমতের সঠিক ও যথার্থ প্রতিফলনের ভিত্তিতে নতুন আইনসভা তথা সরকার গঠনের ব্যবস্থা করবে, সেই সংস্থাকে কোনো অবস্থাতেই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া চলবে না। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরক্ত বা পছন্দের হওয়া চলবে না। সেই সংস্থা অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের। এঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়া হবে এমন,  যেখানে সরাসরি বা পরোক্ষে সরকার বা শাসকদল হস্তক্ষেপ করতে বা প্রভাব বিস্তার করতে  পারবে না। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যদি শাসকদল বা সরকারের ভূমিকা থাকে, তাহলে তারা তাদের পছন্দের লোকদেরই নিয়োগ করবে, যাতে কমিশন তাদের হয়ে কাজ করতে পারে। নির্বাচনে শাসকদলের জয় অনেকটাই নির্বাচন কমিশনই নিশ্চিত করে দেবে। ভারতীয় সংবিধান যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিভূমি তৈরি করে দিয়েছে, সেখানে কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী সরকার কেমন হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে কমিশনের ভূমিকার ওপর। কমিশন যদি নির্ভীক, দৃঢ়, সৎ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়, স্বাধীন স্বচ্ছ অবাধ গণতন্ত্রের প্রহরী হয়, তাহলেই নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন সম্ভব। একমাত্র তখনই সুরক্ষিত থাকতে পারে গণতান্ত্রিক পরিসর। কিন্তু  শেষ পর্যন্ত মোদী সরকার যে আইন তৈরি করছে, তাতে গণতন্ত্রের সলিল সমাধি অনিবার্য। একদলীয়  স্বৈর শাসনের রাস্তাই প্রশস্ত করা হয়েছে। নির্বাচনে শাসকদলের দাপট সর্বগ্রাসী চেহারা নেবে। বিরোধীদের অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া হবে।
কমিশনার ‍‌নিয়োগ সংক্রান্ত বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের মূল ভাবনাকে ভিত্তি ‍ করে নিরপেক্ষ কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও বিরোধী দলনেতার কমিটি গঠন করে দিয়েছে। কিন্তু মোদী সরকার সর্বোচ্চ আদালতের বায়কে বাতিল করে দিয়ে নতুন যে আইন তৈরি করেছে, তাতে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী-মনোনীত কোনো মন্ত্রী এবং বিরোধী নেতার কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছে। সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে মোদীর পছন্দের ব্যক্তিই এই আইনে কমিশনার হবে।  তেমনি যে সার্চ কমিটি প্যানেল তৈরি করবে, সেটা আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে তারই পছন্দের লোকদের নিয়ে গঠন হবে।  অর্থাৎ  প্যানেলে সরকার বা শাসকদলের অপছন্দের কারও জায়গা হবার সুযোগ নেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment