অরবিন্দ সামন্ত
কয়েকদিন আগে কাগজে পড়ছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা-ভূখণ্ডে বিপন্ন শিশু ও সন্ত্রস্ত শৈশবের কথা। কিন্তু আমাদের যে-ভূখণ্ড আপাত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে, সেখানেও কি শিশু আজ নিরাপদ? সেখানেও কি শৈশব নিরুদ্বেগ, অনাবিল, আনন্দচঞ্চল? যৌথ কিংবা খণ্ডিত উভয় পরিবারেই নানা নিরূচ্চারিত মন্ত্রগুপ্তি আর ভ্রুকুটি-শাসনে শিশু আজ সন্ত্রস্ত। শৈশবের স্বপ্নমাখা চোখ, মায়াময় মুখ আর আনন্দঘন চঞ্চল ওড়াওড়ি কোথায় যেন উধাও! অতি সন্তর্পণে তার পদচারণা, কথাবার্তা বড়দের মতই সুচিন্তিত, কাজ সুনিয়ন্ত্রিত। ঘরে ঘরে আজ এ-ধরনের বয়স্ক-শিশুর প্রাদুর্ভাব সত্যিই উদ্বেগজনক। এ হনন-বিশ্বে নানা নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মধ্যে শিশুর শৈশবও নিঃশব্দে হনন করেছি আমরা, প্রাজ্ঞ অভিভাবকের দল।
স্বপ্নমদির চোখে শিশুরা আজ আর স্বপ্ন দেখে না। শিশুর স্বপ্ন দেখার ইজারা তার অভিভাবকরা নিয়ে বসে আছেন। নিজেদের যাবতীয় নষ্ট, ভ্রষ্ট স্বপ্ন তাঁরা সন্তানের মনের মধ্যে গেঁথে দেন। ভূমিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটি গিনিপিগে রূপান্তরিত হয়! হরেক কিসিমের মানসিক ও শারীরিক পরীক্ষার চাপের মধ্যে সে বড় হতে থাকে। ফলত শিশুটির সুস্থতার স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষুণ্ণ হয়। মানসিক যন্ত্রণা শারীরবৃত্তিরও পরিবর্তন ঘটায়। তার ক্ষুধা ব্যাহত হয়, সে সহজেই ক্লান্ত হয়, তার আবেগ অন্তর্গত হয়ে পড়ে, নানা সঙ্কোচ থেকে সে ক্রমাগত সামাজিকভাবে সঙ্কুচিত হতে থাকে। শিকড়হীন, ছাল-বাকলহীন, সেচহীন সে যেন একা-বৃক্ষ-অভিভাবকের সমূহ স্বপ্নপূরণের যন্ত্র, সদা সন্ত্রস্ত বিপন্ন এক মানব শিশু।
আমরা জানি, ব্রেন সার্কিট আর টেস্টোস্টেরন সিস্টেম শৈশবেই গঠিত হয়। শরীরের এই নিউরোবায়োলজিক্যাল সিস্টেমগুলো আমাদের কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, আর শৈশব থেকেই বেঁচে থাকার জন্য তা জরুরি হয়ে পড়ে। একটি শিশু যখন মানসিক চাপ অনুভব করে, তখন তার শরীর, শরীরের মধ্যে প্রবহমান হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এই চাপ যদি অবিরাম এবং দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে শিশুর ভবিষ্যৎ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শিশুদের মস্তিষ্কের সার্কিট দুর্বল, তাই শৈশবে নিরন্তর চাপ, মস্তিষ্কের জন্য জরুরি সংযোগের বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে। আধুনিক গবেষণা বলছে, টক্সিক স্ট্রেস ছোটদের মস্তিষ্কের সার্কিট গঠন ও বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু দীর্ঘ সময় ধরে চরম মানসিক চাপ ভোগ করেছে তাদের মস্তিষ্ক ছোট হয়েই রয়ে গেছে। স্বল্পমেয়াদি মেমরির পরীক্ষা উতরোতেও তাদের সমস্যা হয়।
শিশুদের উপর অভিভাবকীয় সন্ত্রাস শুধুমাত্র শিশুর বাপ-মায়ের অপূর্ণ স্বপ্ন বহনের ক্লান্তিকর ন্যুব্জ অভিজ্ঞতা দিয়েই আসে না। আসে তাদের অসহিষ্ণুতা আর দাম্পত্যবিরোধ থেকেও। ফলত শিশুর মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন হয়, আবেগের সমস্যা হয়, সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তারা শিখে ফেলে, রেগে গেলে তুমুল ঝগড়া করতে হয়, গায়ে প্রচণ্ড আঘাত করতে হয়, পারস্পরিক কুৎসিত দোষারোপ করতে হয়। ইউনিসেফ-এর রিপোর্ট বলছে, যেসব শিশু গার্হস্থ হিংসা দেখে বড় হয়, ভবিষ্যতে তাদের অন্যের সাথে মেলামেশার সমস্যা হয়, তারা অপরাধমূলক কাজকর্মে প্ররোচিত হয়, হিংস্রতার মাধ্যমেই তারা সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজে। তারা বেড়ে ওঠে তীব্র দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বিষণ্ণ মানুষ হিসাবে। লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সাইকাইয়াট্রিস্ট-এর মতে দাম্পত্য বিরোধ যেখানে গার্হস্থ হিংসায় প্রকটিত, সেখানে উদ্বিগ্ন শিশুরা পেট ব্যথার অভিযোগ করতে পারে, তাদের ঘুম অনিয়মিত হয়ে পড়ে অথবা তারা বিছানা ভেজাতে শুরু করতে পারে।
শিশু মনোবিদরা বলছেন, একটি ছোট বাচ্চার বিশ্বজগৎ তার বাবা-মাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। আর সেই বাবা-মা'র সম্পর্ক যদি স্থিতিশীল না হয়, তাহলে সন্তানের জন্য কোনও কিছুই বিশ্বস্ত ও স্থিতিশীল থাকে না। সন্তানের জন্য নিরাপত্তার অনুভূতিটাই মরে যায়! আধুনিক গবেষণা বলছে, প্রায় একবছর বয়েস থেকেই শিশু তার পরিবারের অশান্তির আবহ বুঝতে শিখে যায়। বাবা-মা তাদের ঝগড়ার আপস মিটমাটের কপট অভিনয় করলেও শিশু এই মিথ্যাচারটি সহজেই ধরে ফেলে। অনেক শিশু বাবা-মায়ের ঝগড়া থামাতে নিজেই উদ্যোগী হয় স্রেফ আতঙ্কিত হয়ে, ভালবেসে নয়।
যে শিশু সব সময়ই মন খারাপ করে থাকে, ঘরে বাপ-মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হয়, তার পক্ষে লেখাপড়ায় মনোযোগ ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। অথচ এইসব বাবা-মা'ও ছেলেমেয়েদের ‘শিক্ষিত’করে তোলার সংকল্প করে বসেন। সহপাঠীদের সাথে ফার্স্ট হবার প্রতিযোগিতায় লড়িয়ে দেন। ফলে ঘরে ঘরে চলে সব শিশুদেরই ফার্স্ট করে তোলার মহাযজ্ঞ। ঘুম থেকে উঠেই স্কুল। স্কুলেও সে নিরাপদ নয়, সন্ত্রস্ত। কলকাতায় একটি সমীক্ষাতে দেখা গেছে ৩০ শতাংশ পুরুষ আর ১৭ শতাংশ মহিলা শিক্ষক এখনও বিশ্বাস করেন যে শিশুদের শৃঙ্খলা দেওয়ার জন্য শারীরিক শাস্তি প্রয়োজন! স্কুল শেষে বাড়ি। নাকেমুখে কিছু গুঁজে নিয়েই বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কিংবা পাড়ার কোচিং ক্লাস। কোচিং শেষ হতে না হতেই সন্ধে গড়িয়ে যায়। তারপর স্কুলের হোমটাস্ক। সারাদিনের নিশ্ছিদ্র অবসর। কোথায় বিনোদন? কোথায় খেলাধুলা? স্কুল কিংবা বাড়ি কোনোটাই আর বিনোদন নির্ভর নয়। খেলাধুলা করবে কি? বেচারা তো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারে না! শিশুরা মাঝেমধ্যেই পিঠব্যথায় কাতরায়। শিশু অস্থিবিদ্যার চিকিৎসকরা বলেন, একটি শিশু তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ওজনের বোঝা বয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। এই বোঝা স্কুলব্যাগের বোঝা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও আর শিশুবান্ধব নয়।
লেখাপড়া নয়, যেসব শিশু শৈশবকাল থেকেই সংসারসীমান্তের বাইরে গিয়ে পেটের চিন্তায় দিন গুজরান করতে বাধ্য হয়, তাদের কী হাল? দক্ষিণ কলকাতায় পরিবার, চায়ের স্টল, গ্যারেজ, দোকানে কাজ করে এমন ১২০ জন অভিবাসী শিশু শ্রমিকের উপর সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে, শিশুদের অধিকাংশই শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার। ভারতের মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে পথশিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা সব রকমের দুর্ব্যবহার আর শোষণের শিকার হয়ে রয়েছে। ভারতের লিঙ্গ পার্থক্যের যে সব গবেষণা হয়েছে, সেখানে দেখা যায় মেয়ে শিশুরা তাদের শৈশবে ছেলে শিশুদের তুলনায় বেশি অবহেলা আর নির্যাতনের শিকার।
মোটকথা, ঘরেবাইরে শিশুরা আজ আক্রান্ত, বিপন্ন, সন্ত্রস্ত। শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বাড়িতেও বাবা-মা'র গৃহযুদ্ধের ক্রসফায়ারে পড়ে আর তাদের স্বপ্নপূরণের দায় মাথায় নিয়ে শিশুরা আজ দিশাহারা। তাই অভিভাবকের আজ নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।
(প্রাক্তন অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়।)
Comments :0