Chief minister D.Litt

বিপুল করছাড় পেয়েছে মমতাকে
ডি'লিট দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়

রাজ্য কলকাতা

mamata banerjee dlitt new town bengali news ডি'লিট পাচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। ছবি সংগৃহীত।

অনিন্দ্য হাজরা

কলকাতার এক নামজাদা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ কোটি টাকার কর মুকুব করেছে রাজ্য। বুধবার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ সম্পত্তি কর মুকুবের সুপারিশ করে চিঠি পাঠালেন রাজ্যের অতিরিক্ত সচিব।

প্রসঙ্গত, এই বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মমতা ব্যানার্জিকে ডি’লিট উপাধি দিয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে কোনও যোগসূত্র রয়েছে কিনা, উঠছে সেই প্রশ্নও।
ঘটনার সূত্রপাত ২০১৪ সালে। নিউ টাউনের অ্যাকশন এরিয়া ৩-এ নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় গড়া শুরু করে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলের একটি বেসরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষ। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমিসেস নম্বর ৪৩-৩৩৩৩। এবং প্লট নম্বর বি/১। 

তৎকালীন রাজ্যপালের তরফে নোটিফিকেশন জারি করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পর্যায়ের ভবন নির্মাণের ‘প্ল্যান স্যাংশন ফি’ মকুব করা হয়। ২০১৬ সালেও একইভাবে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভবন নির্মাণের ‘রি-স্যাংশন ফি’ মকুব করে রাজভবন। ২০১৯ সালের পরে রাজ্যের রাজ্যপাল পরিবর্তন হয়। 

এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়টির তরফে নিউ টাউনের দায়িত্বে থাকা ‘নিউটাউন কলকাতা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ বা এনকেডিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চিঠি চালাচালি শুরু হয়। কিন্তু এনকেডিএ কর্তৃপক্ষ নতুন করে বিল্ডিং প্ল্যান ‘রিস্যাংশন ফি’ মকুব করতে রাজি হয়নি। 


এরপরেই বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষের তরফে যোগাযোগ শুরু হয় রাজ্যের পৌর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে। নিজেদের দুর্দশার কথা জানিয়ে ২০২২ সালের ২৩ এপ্রিল রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারপরেই ২৬ এপ্রিল রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর ওএসডি বা অফিসার অন স্পেশাল ডেপুটেশন’র তরফে এনকেডিএ’র কাছে চিঠি পাঠিয়ে গোটা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলা হয়। চিঠিতে উল্লেখ, ‘মন্ত্রীর ইচ্ছানুসারে’! 

প্রশ্ন ওঠে, মন্ত্রী কি আইনের ঊর্ধ্বে? তাঁর ডিসায়ার বা ইচ্ছের ভিত্তিতে এনকেডিএ’র মতো একটি সরকারি সংস্থা কর মুকুব করতে পারে? 


এবার ‘কাট টু’, ২০২৩। আসরে নামলেন রাজ্যের অতিরিক্ত সচিব। তাঁর দপ্তরের তরফে এনকেডিএকে চিঠি পাঠানো হল ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি। সেখানে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির তৃতীয় পর্যায়ের ‘বিল্ডিং প্ল্যান রিস্যাংশন’ ফি বাবদ ২ কোটি ৭ লক্ষ ৬ হাজার ৮ টাকা মুকুব করা যেতে পারে। 

সরকারি নথি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিন দফায় বিল্ডিং প্ল্যান স্যাংশন এবং রি-স্যাংশন ফি বাবদ ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৪কোটি ১৪ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা মুকুব করেছে রাজ্য। এরমধ্যে প্রথম পর্যায়ে মুকুব হয়েছে ৫৯ লক্ষ ৫০ হাজার ৭৫৫ টাকা, দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ কোটি ৪৮ লক্ষ ২০৬ টাকা এবং তৃতীয় পর্যায়ে মুকুব হয়েছে ২ কোটি ৭ লক্ষ ৬ হাজার ৮ টাকা। 
রাজ্যপাল এবং পরবর্তীকালে অতিরিক্ত সচিবের তরফে কর মুকুবের জন্য হাতিয়ার করা হয়েছে ২০০৭ সালের এনকেডিএ অ্যাক্টের ৬৫(৩) ধারা। 

আইনজ্ঞদের বক্তব্য, এই ধারা অনুযায়ী, নিউটাউনের কোনও অংশে ৬৫(৩) বলবৎ হলে তারজন্য আলাদা আইন করতে হবে রাজ্যকে। কেন সেই অংশকে নিউটাউন থেকে আলাদা করা হল, কী তার প্রয়োজন, সমস্তটা সবিস্তারে জানিয়ে জারি করতে হবে নির্দেশিকা। রাজভবন এবং অতিরিক্ত সচিবের চিঠিতে এই ধারা ব্যবহারের কথা বলা থাকলেও, নির্দেশিকা জারির কোনও উল্লেখ নেই। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির তরফে রাজ্যের পৌর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী এবং এনকেডিএকে জানানো হয়েছে, তাঁদের ক্যাম্পাস পুরো তৈরি হয়ে গেলে সম্পত্তি কর গিয়ে দাঁড়াবে আড়াই কোটি টাকায়। এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পরিমাণ অর্থ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই কর মকুব করা হোক। 


এই আবেদনেও প্রাথমিক ভাবে এনকেডিএ সাড়া দেয়নি। কিন্তু রাজ্য দিয়েছে। যদিও সাড়া দেওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে ডি’লিট উপাধি দেওয়া হয়। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে মমতা ব্যানার্জিকে ডি’লিট দেওয়া হয় ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। এবং আড়াই কোটি টাকার সম্পত্তি কর মুকুব করার সুপারিশ করে অতিরিক্ত সচিব এনকেডিএ’র সিইও’কে চিঠি পাঠান ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেই চিঠি বাতিল করে বুধবার, অর্থাৎ ১৫ মার্চ এনকেডিএ'কে চিঠি পাঠান রাজ্যের অতিরিক্ত সচিব। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫০ শতাংশ সম্পত্তি কর মুকুবের সুপারিশ করেছেন।

সুপারিশের চিঠিতে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ২০০৭ সালের এনকেডিএ আইনের ৩৬ই(১)(বি) ধারা অনুযায়ী এনকেডিএ সম্পত্তি কর পুনর্মূল্যায়ন করতে পারে। কর মুকুবের সুপারিশে ৩৬জি(১) ধারার উল্লেখও তিনি করেন।

অতিরিক্ত সচিব সুপারিশ করলেও আইন কি বলছে? আইনজীবীদের একাংশ জানাচ্ছেন, ২০০৭ সালের এনকেডিএ আইনের ৩৬জি(১) ধারা অনুযায়ী, সম্পত্তি কর পুনর্মূল্যায়নের জন্য কমিটি গঠন করতে হয়। কিন্তু এই সংস্থানের সুবিধা কেবলমাত্র আর্থিক ভাবে দুর্বল অংশ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যাঁরা ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালান, তাঁদের কী ভাবে পরোক্ষ ভাবে আর্থিক ভাবে দুর্বল চিহ্নিত করে দিতে পারেন অতিরিক্ত সচিব?

একইভাবে তাঁর উল্লিখিত ৩৬ই(১)(বি) ধারার ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, এই ধারা অনুযায়ী, ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত কোনও জমি, যেমন শ্মশান, কবরখানা, বা প্যারেড গ্রাউন্ড কিংবা সরকার ‘নোটিফাইড’ কোনও নির্মাণকে এই ধারার আওতায় এনে কর ছাড় দেওয়া যেতে পারে। আইনে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, নির্মাণের কোনও অংশ যদি ব্যাবসায়িক ভাবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে এই আইনের সুযোগ মিলবে না।

একইসঙ্গে ৩৬ই(১)(বি) ধারা প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কারণ আইন অনুযায়ী, এই ধারার সুযোগ পেতে গেলে সম্পত্তির মোট আয়তন পাঁচ হাজার স্কোয়ার মিটারের কম হতে হবে, বা ওই জায়গায় ৬৫ বছরের ঊর্ধে কোনও বয়ষ্ক মানুষের বাস হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই দুটির কোনওটিই খাটে না।

Comments :0

Login to leave a comment